ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

সম্রাট আকবর ও বাংলা সনের উদ্ভাবক পণ্ডিত শিরাজী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৭
সম্রাট আকবর ও বাংলা সনের উদ্ভাবক পণ্ডিত শিরাজী সম্রাট আকবর ও বাংলা সনের উদ্ভাবক পণ্ডিত শিরাজী

সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ভারতবর্ষে তখন ভারত সন, লক্ষ্মণ সন, বিক্রম সন, জালালী সন, সেকান্দার সন, শকাব্দ, গুপ্তাব্দ প্রভৃতি সনের প্রচলন ছিল। যে কারণে যে যার মতো দিন তারিখ বা সন গণনা করতো। এজন্য সম্রাটের রাজসভার আমির-ওমরাহরা আকবরের কাছে নতুন সন প্রচলনের আবেদন জানান। তারা ওইসব সনের ত্রুটি বা সমস্যার কথা বলেন।

ওইসব সনের কোনো কোনোটির গণনা করা হতো সৌর রীতিতে। আবার কোনো কোনোটির গণনা করা হতো চান্দ্র মাসের হিসাবে।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ গণনা করতেন চান্দ্র মাসের হিসেবে। ভারতীয় গণনা রীতি অনুসারে, ১২ চান্দ্র মাসে ৩৬০টি তিথি ধরা হতো। তাই সৌর বছরের সঙ্গে চান্দ্র বছরের গরমিল দেখা দিত প্রতি বছরই। এই গরমিল দূর করার জন্য হিন্দু জ্যোতিষীরা গবেষণা শুরু করলেন। তারা চান্দ্র বছরের হিসাবকে সৌর বছরের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়ার জন্য প্রতি তিন চান্দ্র বছরে এক মাস অতিরিক্ত যোগ করে নিতেন। এটিকে তারা বলতেন ‘মলমাস’।

এই জটিল হিসাবের জন্য প্রজাসাধারণের কাজকর্মে খুব অসুবিধা হতো। যদিও সম্রাটের দরবারে বহুকাল থেকে হিজরি সনের প্রচলন ছিল। কিন্তু হিজরি সন চান্দ্র মাসের হিসেবে চলে। এজন্য বিশেষভাবে একটি সৌর সনের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজন বিবেচনা করে আকবরের নির্দেশে একটি সৌর সন প্রবর্তিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে এই নতুন সনকে ‘ফস্লী’ সন বলা হতো। আরবি ‘ফস্ল্’ অর্থাৎ শস্যের সঙ্গে শব্দটির মিল থাকায় এই নামকরণ করা হয়। কারণ ফসল ওঠার পর রাজস্ব আদায় হতো এই সন অনুযায়ী।

পরে বাংলাদেশে এই সনটি বঙ্গাব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলাদেশে সেকালে ‘লক্ষ্মণ সন’ নামক একটি সনও প্রচলিত ছিল। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সিংহাসন লাভের কাল (১১৭৮ খ্রিস্টাব্দ) থেকে এটির গণনা করা হয়। এটির গণনারীতিও ছিল চান্দ্র মাস অনুযায়ী।

এই সৌর সন ‘ফস্লী’ বা ‘বঙ্গাব্দে’র ভিত্তি হিসেবে হিজরি সনকে গ্রহণ করা হয় এবং আকবরের সিংহাসন লাভের বছর (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) থেকে। এবং ওই বছর থেকেই হিজরি সনকে সৌর সনে রূপান্তর করা হয়। সম্রাটের নির্দেশে এ কাজটি করেন আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজী। এজন্য তাকে বলা হয় বাংলা সনের উদ্ভাবক। বিখ্যাত এই জ্যোতির্বিদ সুপণ্ডিতকে তাই বলা হতো পণ্ডিত শিরাজী।  

ফতেহউল্লাহ শিরাজীর বাংলা সন উদ্ভাবনের গল্প বলার আগে বলে নিই বাংলার প্রকৃতি, আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য ও কৃষিকাজের সময়সূচি এখনো বাংলা মাস বা বঙ্গাব্দের সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা যখন রোদ-বৃষ্টি, ঠান্ডা-গরমের কথা বলি তখন ‘কালবৈশাখী’, ‘আষাড়ের বর্ষণ’, ‘শ্রাবণের ধারা’, ‘ভাদ্রের তালপাকা গরম’, ‘শরতের মেঘ’, ‘মাঘ মাসের শীত’ কিংবা ‘ফাল্গুনের হাওয়া’ প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যবহার করি। এতেই বোঝা যায় বাংলা সন বা সাল আমাদের জীবনে, ঐতিহ্যে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে কীভাবে মিশে আছে। কিন্তু অন্তরঙ্গভাবে এই যে বাংলা সালের সঙ্গে মিশে যাওয়া, প্রত্যেক বছর ঢাক-ঢোলা পিটিয়ে বাংলা সনকে স্মরণ করা কে উদ্ভাবন করেছিলেন এমন মধুর বাংলা সনের?

আমরা আগেই বলেছি বাংলা সন আবিষ্কার করেন সুপণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজী। তিনি কীভাবে এ সনের উদ্ভাবন করেছিলেন? আমরা যদি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাই তাহলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইংরেজি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর দিল্লির সিংহাসনে বসেন মুঘল সম্রাট আকবর। তখন আরবি হিজরি সন অনুসারে রাজকার্য চলতো। অর্থাৎ রাজ্যের হিসাব-নিকাশ, কর্মচারীদের বেতন, খাজনা আদায় প্রভৃতি কাজ করা হতো হিজরি সন অনুযায়ী।

একদিন রাজ্যের হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে কয়েক জন সম্রাট আকবরের কাছে গেলেন। বললেন, ‘বাদশাহ আমাদের ধর্মকর্ম সম্পর্কিত অনুষ্ঠানে আরবি অর্থাৎ হিজরি সাল ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয় না। তাই আপনি আমাদের একটি পৃথক সাল নির্দিষ্ট করে দিন। ’ এর কিছুদিন পরেই আবার অসন্তোষ দেখা দিলো সম্রাটের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে। সম্রাটের কাছে তারা তাদের আবেদনে জানান, ‘জাঁহ‍াপনা সৌর পদ্ধতিতে হিজরি সালের কিছু ত্রুটি এবং চান্দ্র সালের কারণে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের সময়কাল নির্দিষ্ট রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় আপনি হিজরি এবং চান্দ্র বর্ষের সমন্বয়ে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন সালের প্রবর্তন করে দিন। যাতে নির্র্দিষ্ট দিন বা সময়ে আমরা জমির খাজনা পরিশোধ করতে পারি’।
সম্রাট আকবর ছিলেন রাজ্যের সুশাসক এবং ধর্মমতের ব্যাপারে উদার। বিষয়টির গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করলেন। এটি নিয়ে আলাপ করলেন তার সভাসদ আবুল ফজলের সঙ্গে। আবুল ফজলের পরামর্শে সম্রাট কঠিন এই কাজটি সম্পাদনের দায়িত্ব দিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজীর ওপর।

শিরাজী বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা করলেন। তারপর হিজরি সালকে অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তিত রেখে উদ্ভাবন করলেন বাংলা সনের। জমা দিলেন সম্রাটের কাছে। সম্রাট আকবর পণ্ডিত শিরাজীর উদ্ভাবিত বাংলা সনকে গ্রহণ করলেন। ওই সময় ইংরেজি সালটা ছিল ১৫৫৬। তারিখ ১০/১১ মার্চ। এখানে উল্লেখ্য শিরাজীর প্রচেষ্টায় ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা বর্ষের অর্থাৎ ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। যেহেতু ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু তিনি চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করেন। চৈত্র ছিল শক বা শকাব্দ বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস যা সে সময় বঙ্গে ব্যবহৃত হতো।

আরেকটি মজার ব্যাপার হলো সম্রাট আকবর যখন বাংলা সন প্রবর্তন করেন তখন গ্রেগোরিয়ান বা ইংরেজি সাল এবং হিজরি বর্ষের মধ্যে পার্থক্য ছিল ১৫৫৬Ñ৯৬৩ = ৫৯৩ বছর। এই ৫৯৩-এর সঙ্গে আমরা যদি নতুন বাংলা সন যোগ করি তাহলে বর্তমান ইংরেজি সাল পাবো। কীভাবে, এখন সেটা বলি। আগত নতুন বাংলা সন ১৪২৪-এর সঙ্গে ৫৯৩-এর যোগ করলে দাঁড়ায় ১৪২৪+৫৯৩ = ২০১৭, অর্থাৎ ইংরেজি ২০১৭ সাল। বাংলা সন গণনার ক্ষেত্রে এত সহজ একটি সমীকরণ আবিষ্কার করার জন্য সালাম আমির ফতুল্লাহ শিরাজী। সালাম সম্রাট আকবর। সালাম সভাসদ আবুল ফজল। স্বাগতম বাংলা ১৪২৪।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।