পাখিছানাটি লম্বা মূর্তিটা দেখে। দেখে যে থাকার জন্যে এটি উত্তম জায়গা।
পাখিছানাটি বলে, ‘আমার আছে সোনার পালঙ্ক। ’ সে ঘুমুবার প্রস্তুতি নেয়। যেই সে ঘুমানোর জন্যে মাথা রেখেছে ওমনি এক ফোটা পানি তার মুখে পড়ে। সে অবাক হয়ে বলে, ‘আজব। এক ফোটা মেঘও নাই আকাশে, তারাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এর মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া আসলেই বিদঘুটে। নলখাড়গাটি বৃষ্টি পছন্দ করত, কিন্তু সেটা নিছকই নিজের স্বার্থে। ’
আরেকটি ফোটা পড়ল।
‘বৃষ্টিতেই যদি ভিজতেই হয় তাহলে আর এই বিশাল মূর্তির নিচে বসে থাকা কেন? বরং খুঁজে দেখি কোথাও একটা চিমনি পাওয়া যায় কি না?’ সে উড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পাখিছানাটি যেই ডানা মেলতে যাবে ওমনি আরেকটি ফোটা পানি পড়ল। পাখিছানা উপরের দিকে তাকায়। তাকিয়ে যা দেখল তা বিশ্বাস করা শক্ত। দেখে যে সুখী রাজপুত্তুরের চোখ দু’টি অশ্র“ভরা, তার সোনালি গাল বেয়ে পানি পড়ছে। জ্যোৎস্নার আলোতে মূর্তিটিকে খুব সুন্দর আর স্নিগ্ধ লাগে। পাখিছানার মায়া লাগছে।
‘তুমি কে?’ পাখিছানা জিজ্ঞেস করে।
‘আমি সুখী রাজপুত্তুর। ’
‘সুখী রাজপুত্তুর হলে আবার কাঁদ কেন? কাঁদতে কাঁদতে তো আমাকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়েছ। ’
মূর্তিটি বলে ওঠে, ‘যখন আমি জীবিত ছিলাম তখন কান্না কাকে বলে আমি জানতাম না। আমি রাজপ্রাসাদে থাকতাম, রাজপ্রাসাদের ভিতর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। সারাটা দিন আমার বন্ধুদের সাথে খেলে কাটাতাম। সন্ধ্যার পর হতো নাচের আসর। আমাদের প্রাসাদের বাগান ঘিরে ছিল উঁচু দেয়াল। দেয়ালের আরেকপাশে কী আছে তা দেখার কথা কখনও মাথায় আসে নি। আমার চারপাশটা ছিল সুন্দর, গোছালো, ছিমছাম, টিপটপ।
সবাই আমাকে বলত সুখী রাজপুত্র। হ্যাঁ, সুখীইতো ছিলাম। বিলাস করাকে যদি সুখ বলা যায়, তবে হ্যাঁ,আমি সুখীই ছিলাম। এই সুখেই দিন কাটালাম। সুখ নিয়েই মারা গেলাম।
মরার পর এখন যখন এই উঁচু খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই শহরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন দেখি তখন আমার মনটা কষ্টে ভরে যায়। আমি কাঁদতে থাকি। ’
পাখিছানা ঠিক ভেবে পায় না একেবারে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি হওয়ার পরও কী করে কারও কোনো দুঃখ থাকতে পারে। যদিও কথাটি মুখ ফুটে বলতে পারে না।
মূর্তিটি মৃদু স্বরে, ধীরে ধীরে বলে যায়, ‘ঐ দূরে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরের একটি জানালা খোলা। আমি দেখতে পাচ্ছি ঘরের ভিতরে একজন রোগা ক্লান্ত মহিলা বসে আছে। তার হাতে সুঁই-সুতা, সে সেলাইয়ের কাজ করছে। সে পোশাকে নকশা করছে, এই পোশাক পরে কেউ রাজবাড়িতে নাচের আসরে যাবে। আর তার ঘরের কোণাতে এক ছোট্ট বাচ্চা শুয়ে আছে, বাচ্চাটা অসুস্থ। বাচ্চাটা কমলা খাবার আবদার করছে। কিন্তু তার মা তাকে নদীর পানি ছাড়া কিছু খেতে দিতে পারছে না। বাচ্চাটা কেঁদে যাচ্ছে। আর আমি এখানে আটকে আছি, কোনো চলা ফেরা করতে পারি না। বাচ্চাটার কাছে যেতে পারছি না।
পাখিছানা শোন, আমার একটা কাজ করে দাও। আমার তলোয়ারের মুষ্টিতে যে রুবি পাথরটা আছে তা নিয়ে ওদের কাছে দিয়ে এসো।
কিন্তু আমাকে তো মিশরে যেতে হবে। সেখানে আমার বন্ধুরা যাবে, নীল নদের ধারে বসবে, ফুলের সাথে কথা বলবে। তারপর রাজার কবরে গিয়ে ঘুমাবে। মমি রাজা হলুদ চাদরে ঢাকা। তার গলায় সবুজ গয়না। হাতগুলো ঝরা শুকনো পাতার মতো।
‘পাখিছানা, পাখিছানা, তুমি কি আজ রাতটা আমার সাথে থাকতে পারবে না? তুমি আমার দূত হয়ে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়ের কাছে যাবে। জানো, বাচ্চাটি খুবই ক্ষুধার্ত আর তার মা কেমন মন খারাপ করে বসে আছে। ’
‘ছোট বাচ্চাদের আমি পছন্দ করি না। জানো, গত গরমের সময় আমি নদীর ধারে বসেছি ওমনি দুইটা দুষ্টু বাচ্চা দৌঁড়ে এসে আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। আমাকে লাগাতে পারে নাই অবশ্য, আমরা পাখিরা ঠিকই উড়ে নিজেদের বাঁচাতে পারি। কিন্তু আমি এখনও বাচ্চাদের ওপর রেগে আছি। ’
তারপরও সুখী রাজপুত্তুরের দুঃখী মুখ দেখে পাখিছানা চলে যেতে পারল না। পাখিছানা বলে, ‘যদিও এখানে ঠাণ্ডা, তারপরও আজকে রাতটা আমি তোমার সাথে থাকব, তোমার দূতের কাজ করে দেব।
‘আমি খুবই খুশী হলাম’ রাজপুত্তুর পাখিছানাকে বলে।
পাখিছানা লাল রুবি পাথরটা নিয়ে শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। পাখিছানা শুভ্র মূর্তি দিয়ে ঘেরা চার্চের ওপর দিয়ে উড়ে রাজপ্রাসাদ পেরুবার সময় শুনতে পায় রাজপ্রাসাদের ভিতর থেকে নাচ গানের সুমধুর সুর ভেসে আসছে। সেখানে একজন প্রেমিক তার সুন্দরী প্রেয়সীকে বলছে, ‘আকাশের তারাগুলো কী সুন্দর, ঠিক আমাদের ভালবাসার মতো। ’ জবাবে সুন্দরী মেয়েটি বলে, ‘আমি চিন্তায় আছি সময় মতো কালকের নাচের পোশাকটি পাব কি না? যাকে নকশা করতে দিয়েছি সে খুব অলস। ’
প্রথম পর্ব