প্রিয়তি আকাশ চেনে না। কিন্তু আকাশ দেখে।
প্রিয়তি এখন অনেক কিছুতেই হাত বুলায়। ঝকঝকে পাকা মেঝেতে হাত বুলায়। মেঝেতে পড়ে থাকা পানিতে হাত বুলায়। মেঝেতে এসে পড়া রোদে হাত বুলায়। রোদ ধরতে যায় ও। ও কি রোদ ধরতে পারে? রোদ কি আসলেই ধরা যায়? প্রিয়তি ভাবে রোদ ধরা যায়। এজন্য সে হাতের দুই আঙুল দিয়ে এক টুকরা রোদ ধরতে চায়। রোদ ধরে উপরের দিকে ওঠানোর চেষ্টা করে। হাত উপরে ওঠানোর পর দেখে তার হাতে কিছুই নেই। সে আবারো একই চেষ্টা করে। একসময় সে বিরক্ত হয়। রোদের সঙ্গে এমন খেলায় হেরে রাগ করে। উঁহুঁ উঁহুঁ- কেঁদে ওঠে। চোখ ভরে যায় পানিতে। টলটলে চোখে রোদ খেলা করে। রোদও যেনো একসময় ভিজে যায়। রোদ ভিজে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রিয়তিও ঠান্ডা হয়। রোদ প্রিয়তির চোখের পানি উড়িয়ে নিয়ে যায় আকাশে।
আকাশটা আজ ভীষণ নীল। কিছু মেঘ এলেমেলো কোথায় জানি উড়ে যাচ্ছে। প্রিয়তি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখে। কিন্তু প্রিয়তি তো আকাশ চেনে না। মেঘ চেনে না। তাহলে ও কী দেখছে? দেখে না, ও বেশিক্ষণ আকাশ দেখে না। মেঘ দেখে না। মুখ ফিরিয়ে সে একটি পাখি দেখে। পাখিটি পাশের বাড়ির জানালার সানসেডে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিটির নাম সে জানে না। পাখিটি তাকে কি কিছু বলবে?
প্রিয়তির নাম না জানা পাখিটি চড়ুই। চড়ুই কিচির মিচির করে বললো, তুমি তো রোদ ধরতে পারবে না। রোদ ধরা যায় না। রোদ ধরতে গেলে আকাশে উড়তে হবে। রোদ ছুঁতে গেলে আমার সাথে ভেসে বেড়াতে হবে আকাশে। চড়ুইয়ের এই কথা কি প্রিয়তি বোঝে? বোঝে না। কোনো কিছু না বুঝে প্রিয়তি পাখিটিকে হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। আর তখনই শুরু হয় চিৎকার। প্রিয়তির চিৎকারে ঢাকা পড়ে চড়ুইয়ের কিচির মিচির। চড়ুই তখন সানসেড থেকে নেমে আসে প্রিয়তিদের ঘরের বারান্দার গ্রিলে। প্রিয়তি হামাগুড়ি দিয়ে গ্রিলের পাশে যায়। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। এখন তারা মুখোমুখি। দুজনই ছোট। দুজনই কথাও বলে ছোট ছোট। চড়ুই কী বলে প্রিয়তি বোঝে না। আবার প্রিয়তি কী বলে চড়ুই বোঝে না। তবে তারা দুজনই একসময় থেমে যায়। দুজনই চুপ। দুজনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা নেই। কোনো শব্দ নেই। ওরা তাহলে চুপচাপ কী করছে?
দুজনই খেলা করছে। টবের একটি গাছ নিয়ে খেলছে দুজন। গাছটির পাতাও ছোট ছোট। তবে বেশ ঝাকড়া। গাছটিতে সাদা রঙের ফুল ফুটেছে। কিছু ফুল শুকিয়ে আছে ঝুলে থাকা ফলের নিচে। তারা দুজন মনের আনন্দে গাছের পাতা ছিড়তে থাকে। ফুল ছিড়তে থাকে। ফল ছিড়তে থাকে। গাছে একসময় আর কোনো পাতা থাকে না। ফুল থাকে না। ফল থাকে না। এগুলো নিয়ে তারা খেলতে থাকে। চড়ুই পাখি খুটে খুটে পাতা খায়। ফুল খায়। প্রিয়তিও পাখির দেখাদেখি গাছের পাতা, ফুল মুখে দেয়। মুখ নাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। ফেলে দেয়। চড়ুই বলে এগুলো ফেলে দিচ্ছো কেনো? এগুলো তো খুব মজার খাবার। তোমার কাছে মজা লাগছে না? প্রিয়তি কিছু না বলে পাতা ফুল নিয়ে খেলতে থাকে।
খেলতে খেলতে প্রিয়তি হাত বাড়িয়ে পাখিকে ধরতে যায়। পাখি চিঁ চিঁ করে ডেকে মেঝে থেকে উড়ে গ্রিলে বসে। প্রিয়তি দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে পাখিকে ধরার চেষ্টা করে। আর তখনই চড়ুই উড়ে মেঝেতে গিয়ে বসে। প্রিয়তিও বসে পড়ে মেঝেতে। চড়ুই প্রিয়তির পায়ের ছোট ছোট আঙুলে ঠোঁট দিয়ে আদর করতে থাকে। ঠেঁটের ছোঁয়ায় প্রিয়তির সারা গা শিরশির করে ওঠে। চটকরে পা টেনে নেয় কোলের দিকে। তারপর পা দাপিয়ে চড়ুইকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে পাখিকে ধরার চেষ্টা করে। পাখি ডানা ঝাপটে সরে যায় পিছন দিকে। আবার আসে প্রিয়তির পায়ের সামনে। প্রিয়তি আবার হাত পা দাপিয়ে পাখিকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। এভাবেই চলতে থাকে তাদের খেলা।
এমন খেলা চলে অনেকক্ষণ। কিন্তু কেউ কাউকে ধরতে পারে না। ধরে মেঝেতে পড়ে থাকা গাছের পাতা ফুল ফল। খেলতে খেলতে চড়ুই প্রথম লম্বাটে সবুজ ফলটি মুখে দেয়। চড়ুইয়ের দেখাদেখি প্রিয়তিও মুখে দেয় ফলটি। সদ্য ওঠা দুটি দাঁত দিয়ে ফলটি কামড়াতে থাকে। আর তখনই সে হাত পা ছুড়ে চিৎকার শুরু করে। বারবার মুখে হাত ঘষতে থাকে। হামাগুড়ি দিয়ে এদিক, ওদিক যেতে থাকে। ফলটির ঝালে তার ঠোঁট মুখ লাল হয়ে যায়। মাথা ঘেমে ওঠে। মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে। চোখ থেকে ঝরতে থাকে পানি। প্রিয়তির এমন অবস্থা দেখে চড়ুই ডানা ঝাপটিয়ে কিচির মিচির করতে থাকে। প্রিয়তির আশপাশে ঘুরে কী যেন বলতে চায়। কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে ফলটি মুখে দেয়ার কারণেই সে এমন করছে। চড়ুই তখন প্রিয়তির হাত থেকে ফলটির বাকি অংশ ছোঁ মেরে নিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। এমন সময় প্রিয়তির মা দৌড়ে আসেন। তাকে দেখে চড়ুই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। পিছনে ফিরে দেখে প্রিয়তিকে কোলে তুলে মা ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছেন।