ফল্গু শুনেছিলো তার মামা যুদ্ধের ব্যবসায় বড়োলোক হয়েছেন, কিন্তু সে-বড়োলোক মানে যে এই তা সে ভাবতেও পারেনি। কেমন করেই বা পারবে।
কয়েক বছর আগে একবার মা-র সঙ্গে মামাবাড়ি এসেছিলো সে- মনে পড়ে সাপের মতো একটা গলি, দোতালায় দু-খানা ঘর; একতলায় ঘুটঘুট্টি রান্নাঘর আর এঁদো কলতলা- সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে যে একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ নাকে আসতো তা সে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারেনি। আর এবার সে যেখানে এসে উঠলো, সে একটা মস্ত, আস্ত দোতলা বাড়ি, বড়ো-বড়ো ঘর, চারটে বাথরুম, বাথরুমে কত সব কলকব্জা, ঘরে-ঘরে কত রকমের কত আশবাব, কার্পেট, পিয়ানো, ছবি- তিনটে গারাজে তিনখানা গাড়ি, কখনো মামা বেরোচ্ছেন ছোটো গাড়ি নিয়ে কাজে, কখনো মামি বেরোচ্ছেন বড়ো গাড়ি নিয়ে শাড়ি কিনতে, কখনো বকুল- তাদের মেয়ে- মেজ গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে কলেজে কিংবা বন্ধুর বাড়িতে চা খেতে।
এ কি ভোজবাজি? না কি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ?
সবই তো ভালো, কিন্তু ফল্গুর যেন কিছুই ভালো লাগে না। সে ভালো করে স্নান করতে পারে না, পাছে তার কোনোরকম অসাবধানতায় বাথরুমের মেঝে ভিজে যায়; ভালো করে খেতে পারে না, পাছে টেবিলের ধবধবে কাপড়ে মাছের ঝোলের দাগ লাগে; ভালো করে বসতে পারে না, পাছে তার জামা-কাপড়ের সংস্পর্শে চেয়ারের গদি ময়লা হয়। মাদারীপুর থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে সে এসেছে কলেজে পড়বে বলে- মামাবাড়িতে থাকবে এ তো ধরাধার্য, অথচ মনে-মনে সে এমন হাঁপিয়ে উঠলো যে তার কেবলই মনে হতে লাগলো হস্টেলে থাকাই তার ভালো। অথচ কেমন করে সে কথাটা পাড়বে কিছুতেই ভেবে পেলো না।
মামা তাকে দেখে খুব খুশি, মামিও যত্ন করেন খুব, কিন্তু তাতে কী? ভারি একা-একা, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে তার- কলেজের ক্লাশ এখনো আরম্ভ হয়নি- সারাদিন কিছু করবার নেই। একদিন মামি তাকে বললেন, ‘একা-একা চুপচাপ বসে আছো কেন- যাও না ওখানে, পানু-ভানু খেলার খবর শুনছে রেডিওতে- রেডিও ভালো লাগে না তোমার?’
ফল্গু মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো।
‘রেডিওতে গান-টানও শুনতে পারো- আর যদি গ্রামোফোন তোমার ভালো লাগে, বকুলকে বোলো বের করে শোনাবে। যখন যা ইচ্ছে হয় বোলো, লজ্জা কোরো, না,’ মামিমা অভয় দিয়ে হাসলেন।
লজ্জা একটু-একটু করে বইকি, নয়তো ফল্গু দু-একখানা বই চেয়ে নিতো। ড্রয়িংরুমে ঝকঝকে একটি আলমারিতে মোটা-মোটা ঝকঝকে থরে-থরে সাজানো, দেখে ফল্গু মুগ্ধ হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে। একদিন, কাছাকাছি যখন কেউ ছিলো না, আলমারিটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে সে- কাচের ভিতর দিয়ে বইগুলির নাম পড়েছে- সারি সারি ইংরিজি বই, এনসাইক্লোপিডিয়া, জীবজন্তুর কথা, বিজ্ঞান, আরো কত কী। কিন্তু সবচেয়ে তাকে উতলা করেছে এক সেট রবীন্দ্র-রচনাবলী, ঘন ব্রাউন রঙে বাঁধানো পাশাপাশি আঠারোখানি বই- দু-খানি করে মলাটের মধ্যে বাঁধা আছে কত সৌন্দর্য, কত আনন্দ, কত বিস্ময়। একখানা পুরোনো পাতা-ছেঁড়া চয়নিকা সে পেয়েছিলো একবার, পড়তে-পড়তে আগাগোড়া প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের আর বিশেষ কিছু সে পড়েনি। শুনেছিলো খণ্ডে খণ্ডে রবীন্দ্র-রচনাবলী বেরোচ্ছে, একখানাও চোখে দ্যাখেনি এ-পর্যন্ত। একসঙ্গে সমস্তগুলি খণ্ড শুধু চোখ দিয়ে দেখে-দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সে। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কাচের উপর সস্নেহে হাত বুলিয়েছিলো, কাচের সঙ্গে নাক ঠেকিয়ে যেন নিঃশ্বাস দিয়ে বইয়ের ভিতরটাকে শুষে নিয়েছিলো। না- হস্টেলে গিয়ে কাজ নেই, এখানেই থাকবে সে, তাহলে তো সমস্ত রচনাবলী সে পড়ে ফেলতে পারবে, ফিরিয়ে দেবার তাগিদ থাকবে না বলে পড়তে পারবে বার-বার।
মামা ভারি ব্যস্ত- তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম দিন দু-চারটে যা কথা হয়েছে, তার পরে বলতে গেলে আর দেখাই হয়নি। সেদিন কী ভাগ্যে মামা একটু শিগগির বাড়ি ফিরলেন, রাত্রে খাওয়ার পরে ড্রয়িংরুমে বসে পান চিবোতে-চিবোতে ফল্গুকে ডাকলেন কাছে। এ-কথা ও-কথার পর ফল্গু বললে, ‘তোমার রবীন্দ্র-রচনাবলীর পুরো সেট আছে দেখছি। ’
‘অ্যাঁ?’
ফল্গু আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আবার বললে, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলীর পুরো সেট দেখছি। ’
‘না, না, পুরো আর কোথায়- এখনো আরো অনেকগুলো ভল্যুম বেরোবে। আলমারিতে জায়গা রেখেছি, দেখছো না। ’
মামি বললেন, ‘বেশ সুন্দর বইগুলো, না?’
মামা বললেন, ‘হ্যাঁ- মন্দ করেনি একরকম, তবে সোনালি অক্ষরে নাম লেখাটা কিছুতেই বিলেতি বইয়ের মতো হয় না। ’
‘নীল রঙের মলাট হলে আরো ভালো হতো- লাইট ব্লু দেয়ালের সঙ্গে ডার্ক ব্লু বই ম্যাচ করতো বেশ,’ বলে মামি একটু হাসলেন।
‘ঐ তোমার এক নীল বাতিক হয়েছে-’ মামা বলে উঠলেন, ‘বারো শো টাকা দিয়ে ব্ল্যাক মার্কেটে এনসাইক্লোপিডিয়া কিনতে হলো শুধু তোমার নীলের শখ মেটাতে। ’
‘আলমারিতে সবগুলো বই যদি ঐ-রকম নীল রঙের হতো তাহলে কি খুবই সুন্দর হতো না? ফল্গু কী বলো?’ ফল্গুকে স্বপক্ষে টানার চেষ্টায় মামি তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন একটু।
ফল্গু কী বলবে ভেবে পেলো না।
‘এই দ্যাখো, কার্পেটেও নীল রয়েছে,’ মামি বলতে লাগলেন। ‘এই কার্পেট আর ঐ ছবিখানা একদিনে কেনা হয়েছিলো- দুটোই পছন্দ করেছিলাম আমি- ঠিক কার্পেটের লাল, নীল আর হলদেই ছবিতে দেখতে পাচ্ছো তো! কেমন মিলেছে!’
ফল্গু ছবিখানার দিকে একটু তাকিয়ে রইলো।
মামি একটু নড়ে-চড়ে বললেন, ‘কার আঁকা জানো তো ছবিখানা? যামিনী রায়ের- এ যুগের সবচেয়ে বড়ো আর্টিস্ট উনি। ’
‘দ্যাখো,’ মামা বলে উঠলেন, ‘একতলার বসবার ঘরটা বড়ো ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখায়- খান দুই ছবি ওখানেও রাখলে হয়। ’
‘ওটাকে একটা আপিশ-ঘর করে রেখেছো তুমি- ওখানে কি আর ছবি মানাবে?’
‘তা মন্দ বলোনি। তাহলে এক কাজ করা যাক, ওটাকেও একটা ড্রয়িংরুম করে ফেলি- শান্তিনিকেতন ধরনের- একটু ওরিএন্টাল- ঘর সাজানো হয়ে গেলে তুমি পছন্দ করে ছবি কিনো- এ-সব বিষয়ে তোমার একটু ন্যাকই আছে দেখছি। ’
মামি খুশি হয়ে একটু হাসলেন, তারপর চললো দু-জনের মধ্যে একতলার ড্রয়িংরুমের পরিকল্পনা, তার পরদা, তার কুশান, তার সেন্টার-টেবল, তার কত রকম খুঁটিনাটি। রবীন্দ্র-রচনাবলীর কথা উত্থাপন করার আর সুযোগই পেলো না ফল্গু- সাহসও পেলো না, সত্যি বলতে।
চলবে.....