স্কুল ছুটির সঙ্গে সঙ্গে তপু আর সব বন্ধুরা হৈ চৈ করে বেড়িয়ে পড়ে খেলার মাঠে।
সবার মাঝ থেকে পটকা বাবুল বলে ওঠলো, ‘চল চরে যাই।
বাবুলের কথায় সবাই রাজি হলেও, তপু কিছুটা বেকে বসলো। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে শেষে তপু বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে রওনা করে।
কীর্তনখোলার পাড়ে আইচার চর আরো একটু বেশি জায়গা নিয়ে এবার জেগে ওঠেছে। বর্ষার নতুন পানিতে চরে হেটে ওঠছে ছোট বড় চিংড়ি মাছ। অনেক মানুষ ছুটাছুটি করে ধরছে চিংড়ি। তপুরাও দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে নেমে পড়ে চিংড়ি ধরতে।
ঠেলা-ঠেলি, দৌঁড়-ঝাপের সঙ্গে সঙ্গে কখন যে সময় চলে গেল কেউ টেরই পেল না। পেটের মধ্যে যখন ক্ষুধার কামড় শুরু হলো তখন সবার হুশ হল। সূর্য প্রায় অস্ত যায় যায়। তপু বললো, ‘এইরে সন্ধ্যা হয়ে এলো। না জানি আজ কপালে কি আছে। বাবা তো আজ আমাকে ছাড়বে না। ’
তপুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বন্ধুদের সাথে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বাড়ির কাছে আসতেই কানে আসে বাবার গুরুগম্ভীর হুঙ্কার। তপুর বাবা জুলফিকার আলী সাহেব ঘরের মধ্যে লাঠি হাতে পায়চারি করছেন আর বলছেন, ‘আসুক আজকে হতচ্ছারাটা। আজ ওর একদিন কি, আমার একদিন। কে বাঁচায় আজ ওকে, দেখবো। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়ানো। আজকে আর রেহাই নেই। ’
তপু আস্তে আস্তে গিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়ায়। জুলফিকার সাহেব তপুকে দেখেই এক হুঙ্কারে সামনে এসে খাড়া। এদিকে তপুর প্রাণ পাখিতো যায় যায়। তপু দাঁড়িয়ে থাকে বাবার সামনে মাথা নিচু করে অপরাধীর মত। হাত থেকে চিংড়ি মাছের পোটলাটা পড়ে যায়। কোন কিছু বোঝার আগেই বাবা সজোরে এক চড় বসিয়ে দেন তপুর গালে। তার পরের ঘটনা তপুর আর জানা নেই।
গভীর রাত। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। কোথায়ও কোন সাড়া শব্দ নেই। মাথার কাছে বসে জল পট্টি দিচ্ছেন জুলফিকার সাহেব। তপু জ্বরের তাড়নায়, মাঝে মাঝে বিকার কাটছে। জুলফিকার সাহেব অচেতনের মত বসে আছে। এমন সময় তপু বলে ওঠলো, ‘বাবা আমাকে আর মেরো না। আমি আর করবো না। ’
কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার দেখে গেছে আর বলেছে, ভয়ে এমনটা হয়েছে। আরো বলেছেন, জুলফিকার সাহেব ভয় দিয়ে নয়। স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে সন্তানদের বড় করুন। নিস্তব্ধ ঘরে তপুর মাথার কাছে বসে পরম মমতায় তপুর মাথায় হাত বুলিয়ে জুলফিকার আলী। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার ছবি।
জুলফিকার সাহেবের বাবা, ছোট জুলফিকারের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। ফেরার পথে বৃষ্টির কারণে ভীষন কাঁদা। তাই ছেলেকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাবার কাঁধে বসে কত কথাই না বলছে জুলফিকার।
বাবা বলছে, ‘বাজান তুই যহন বড় হবি তোর পোলারেও এই ভাবে কান্ধে কইরা নিয়া যাবি। দেখবি তহন কি সুখ। ’ সেদিন ছোট্ট জুলফিকার বাবার কথা বুঝেনি। কিন্তু আজ ছোট তপুর মাথার কাছে একাকী বসে বুঝছে বাবার কথাটি। আজ বাবা নেই, খুব মনে পড়ছে বাবার কথা। জুলফিকার সাহেব তপুর মুখের দিকে আড় চোখে তাকায়। আর সেই মুখেই দেখতে পায় সেই কোমল-স্নেহ মাখা বাবার মুখ খানী।
জুলফিকার আলী তপু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘বাবারে আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি কখনো আর তোকে মারবো না। আমি তোর বন্ধু হতে চাই। বন্ধুর মত তোর পাশে সারা জীবন থাকতে চাই। ’
পাশের মসজিদ থেকে হঠাৎ ভেসে আসে আযানের ধ্বনি। জুলফিকার সাহেব টের পেলেন, তার চোখের কোনে জল জমেছে।