ধনু ডাকাতের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তার যেমন গায়ের শক্তি তেমন দুঃসাহস।
এক রাতে ডাকাতি করে বাড়ি ফিরছিল ধনু ডাকাত। নীরব-নিস্তব্ধ গভীর রাত। পথের দু’পাশে ছোট বড় নানা জাতের গাছ, মাঝেমধ্যে লতাপাতার কুণ্ডলি। তার কাঁধে একটা ঝোলা। কোমরে গামছা বাঁধা।
ধনু ডাকাতের মনে হলো, কিছু একটা তার পিছু নিয়েছে, তার পায়ে পায়ে হাঁটছে। কিন্তু ভয় পেলো না সে।
কে? আমার গায়ে গায়ে হাঁটছিস! কী চাস? কথা কস না কে? কোনো সাড়া না পেয়ে রাগের চোটে পেছনে ঘাড় ফিরিয়েই থ হয়ে গেলো দুর্ধর্ষ ধনু ডাকাত।
একটি ছায়া! অবিকল তার আকৃতির ছায়াটি তার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া তো হয় কালো কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা একটা ছায়া। ধনু ডাকাত যা বলছে, যা করছে, সাদা ছায়াটিও তাই বলছে-করছে। ধনুর চক্ষু ছানাবড়া।
ধনু ডাকাত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে লাগলো। পেছনে তাকালো না, আড়চোখে দেখলো ছায়াটি আগের মতোই তাকে অনুসরণ করছে। এই নির্জন রাতে একজন মানুষ আর একটি সাদা ছায়া লাগালাগি করে হাঁটছে। শব্দ নেই। শুধু হনহনিয়ে হাঁটা। কি মুশকিল!
হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো অসম্ভব রাগী ধনু ডাকাত। গভীর রাতে চলাফেরা করা তার অভ্যাস। রাতবিরাতে চলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে ভূত-পেরেতের সাক্ষাৎ পেলেও থোড়াই কেয়ার করে সে। কিন্তু এমন ছায়ারহস্যের মধ্যে পড়েনি কোনোদিন। কিন্তু ধনু ডাকাত তো সহজে ভয় পাওয়ার লোক নয়। ধনু পেছনে না ফিরেই ভারী গলায় বলল, ‘তুই কে রে! বলেই সটান দাঁড়িয়ে গেলো সে। দাঁড়িয়ে গেলো ছায়াটিও। এবার দু’জন মুখোমুখি হলো।
কি চাস? বল।
-আমি আপনার বিবেক। আমি এইমাত্র আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আপনার ভেতরে আর থাকতে পারছি না আমি। বলল ছায়াটি।
-তুই আমার বিবেক? বাইরে কী করস তুই? বিবেক ছাড়া মানুষ চলে কীভাবে? বলল ধনু।
-না, আপনি বিবেক ছাড়া মানুষ নন। আপনার ভেতরে রয়েছে আরেকটা বিবেক। অতি দুষ্টু ও বদ বিবেক। সে আপনাকে বশ মানিয়ে আপনার ভেতরে অর্জন করেছে প্রবল শক্তি-সামর্থ্য। আপনাকে সে ভুলপথে পরিচালিত করছে প্রতিনিয়ত। তার কথায় আপনি চলছেন-বলছেন আর ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আমার কোনো কথাই শুনছেন না আপনি। তাই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি আপনাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে চাই। হয় আপনি আমার কথামত চলবেন, নয় আমি আপনাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাবো?
ধনু ডাকাতের পেশা ডাকাতি। সে এইমাত্র ডাকাতি করে এসেছে। তার তিরিক্ষি মেজাজ আরও তিরিক্ষি হচ্ছে। ধনু ডাকাত একটা বোতল বের করে মুখে দিতেই ছায়াটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো বোতলটি। ধনু রাগে আগুন হয়ে গেলো। সে কোনো কথা না বলে কটি থেকে বের করলো একটা ছুরি। অন্ধকারে ছুরিটি কেমন ঝিলিক দিয়ে উঠলো। ধনু ডাকাত ছুরিটি নাড়াচাড়া করে ছায়াটিকে দেখিয়ে বলল,
এটা কি তুই চিনস?
চিনি, এটা একটা ছুরি, জবাব দিল ছায়াটি।
ধনু বলল, এটা দিয়ে কী করি জানস?
আলবৎ জানি, ছায়াটি বলল।
যদি জানস তো কোন সাহসে আমার সামনে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস। আমি এই ছুরি দিয়ে তোকে চাক চাক করে ফেলব। তুই ভাগ এখান থেকে।
ছায়াটি দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল আগের মতো। একটু নড়া-চড়াও করলো না।
ছায়াটি সরলভাবে বললো, এ জীবনে আপনি কয়টি ভালো আর কয়টি খারাপ কাজ করেছেন, আপনার নির্মমতা কত মানুষের জীবনে কত দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ হয়ে আছে, কত কান্না, কত হাহাকার কত অশ্রু ঝরিয়েছেন আর কত মানুষের অভিশাপ বয়ে চলেছেন আপনি। একটু ভেবে দেখেন তো ওসব কি আপনার বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল? বেঁচে থাকার জন্য কি এরচেয়ে ভালো কোনো পথ নেই? তবে কেন মানুষ হয়ে পশুর মতো কাজ করে এভাবে মানুষের অভিশাপ নিয়ে চলেছেন আপনি? বলুন, জবাব দিন।
ধনু ডাকাত ঝিম মেরে বসে রইলো। তার দু’চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার হাতে নির্মমভাবে আহত-নিহত হওয়া ও লুটপাটের সময় মানুষের আহাজারির করুন চিত্র বিচিত্রভাবে ভেসে উঠলো। তার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার সমস্ত শরীর ঘেমে সয়লাব।
প্রচণ্ড বেগে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ধনু। মনে হলো তার শ্বাসের সঙ্গে একটা দানব বেরিয়ে গেলো। ধনু ডাকাত উঠে দাঁড়ালো ও হঠাৎ করে ছায়াটিকে ঝাপটে ধরে আলিঙ্গন করতে লাগলো। পরে সে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেলো।
তারপর ধনু ডাকাতকে আর রাতের অন্ধকারে ঘরের বাইরে কদম ফেলতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯
এএ