গ্রীষ্মকাল। মাঝে-মাঝে তবু বৃষ্টি নামে।
মেয়ে-বুলবুলি বাসা বানানোতে ব্যস্ত। অন্যটি একসময় ফরফর করে উড়ে এলো দক্ষিণ দিক থেকে। বাসা বাঁধল তারা। অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে তারা। বিশাল প্রান্তর আর নাফ নদী পেরিয়ে মায়ানমার থেকে এসেছে। এই উড়ে আসার পথে কত যে বিপদ। আসার সময় ঝড়ো বাতাসের মাঝখানে পড়েছিল ওরা। পাখি দুটো তবু দমেনি। তাদের চোখে ছিল বাসা বানানোর স্বপ্ন। সবুজ পাহাড়ের নিরিবিলি খাঁজে বাসা তৈরি করতে পেরে পাখি দুটো তাই ভীষণ খুশি। একসময় তাদের ডিম পাড়ারও সময় হলো। হালকা গোলাপি ডিম।
দিনের পর দিন গড়াল। মেয়ে-বুলবুলি ডিমে তা দিতে বসল। কোনো দিকে তার খেয়াল নেই। নজর নেই। নিজের মনে সে তা দিতে লাগল। ওমা! একদিন কী সুন্দর ফুটফুটে দুটো বাচ্চা বেরোল ডিম থেকে। পাখি দুটোর খুশি যেন তখন আর ধরে না। বাচ্চারা দেখতে যেন হয়েছে ঠিক তাদের মায়ের মতো।
গড়িয়ে গেল বেশ কিছুদিন। বাচ্চাদের বাবা যখন খাবারের খোঁজে সমুদ্রের দিকে উড়ে চলে তখন মা বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে থাকে। বাচ্চাকে দেখাশোনা করে। নজর রাখে। বাচ্চাকে শান্ত রাখতে হয় গান শুনিয়ে শুনিয়ে। মা যখন কাজে বাসার বাইরে বেরোয় তখন বাবাকে ঘরে থাকতে হয়। মার মতো বাবা তো আর গান গাইতে পারে না। বাচ্চার তখন পাখা গজিয়েছে। মা বাসায়। মাঝে-মাঝে বাচ্চাটা ওড়ার চেষ্টা করে। এখন আর এক মুহূর্তও স্থির হয়ে থাকতে চায় না বাচ্চারা। প্রচণ্ড দুরন্ত আর চটপটে হয়েছে ওরা। বাসার মাঝে একদণ্ডও থাকতে চায় না। লাল পুঁতির মতো চোখদুটো মেলে এদিক-সেদিক তাকায়। ডানা ঝাপটে বেরিয়ে আসে। তিরতির করে ঘোরে। এখানে যায়। সেখানে যায়। ঝুপ নিচে পড়ে যায়। মা মানা করে। এখন উড়িস নে বাপু। কয়েকদিন পর যখন সময় হবে তখন উড়বি। নীল আকাশের ডানা দুটো মেলে দিয়ে উড়বি। চলে যাবি অনেক দূরে। কে শোনে কার কথা। বাচ্চাটা বারবার চায় উড়তে। শুধু উড়তে। শেষ পর্যন্ত মা ছড়া গান ধরল।
ছোট্ট দুটি সোনামণির
জোর বেড়েছে পায়ের,
তারা এখন শুনবে কেন
নিষেধ বাবা-মায়ের।
তাদের পিঠের দুদিক থেকে
বের হয়েছে ডানা
তাই তো তারা শুনছে না আর
কারও নিষেধ-মানা।
চোখে-মুখে সারাটা দিন
দুষ্টুমি আর হাসি
বুদ্ধি ভরা মাথা তাদের
তবু ভালোবাসি।
মা যখন গানটা গাচ্ছিল ঠিক সে সময় একটা কাক উড়ে যাচ্ছিল ওই পথ দিয়ে। কাকটা দেখল পুরো ব্যাপারটা। একটা পাথরের টিলার ওপর বসে পড়ল সে। মা-পাখিটা মমতামাখা সুরে তার আদরের ছানাদের গান শোনাচ্ছে। মা-পাখির ডানার নিচে শুয়ে আছে তুলতুলে ছানা দুটি। ছানা দুটি বুঝি তাদের মায়ের চোখের মণি। গানটির রেশ ছড়িয়ে গেল চারপাশে। কাকের মনেও দোলা লাগল। বড় ভালো লাগল তার গানটা। এ গান যে তাকে শিখতেই হবে।
‘আমাকে দিয়ে দাও তোমার ওই গান। ’ কাকটা তখন মা-পাখিকে অনুনয় বিনয় করল। অনুরোধ করল।
মা পাখি তখন অপ্রস্তুত। এ কী করে সম্ভব? তার যে একটি গানই শুধু জানা। আর তা কিনা দিতে হবে কুচ্ছিত এই কাকটাকে।
কাকটা কোনো কথাই শুনবে না মা-পাখির। গান তাকে শেখাতে হবেই। নইলে যে তার জীবনটাই বৃথা। মা-পাখি এতে কিছুতেই রাজি না। এক সময় কাক ভীষণ রেগে গেল। ধেয়ে গেল মা-পাখিটার দিকে। তার মনে রয়েছে দুষ্টু বুদ্ধি। কাক মা-পাখির মুখ থেকে গানটা চুরি করে নিয়ে পালাল।
মা-পাখির তখন সে কী কান্না। সারা দিন কাঁদে। শুধু কাঁদে। তার কান্না দেখে সবাই কান্না জুড়ে দেয়। বাবা পাখি সারা দিন পর খাবার-দাবার জোগাড় করে ঘরে ফিরে দেখে বুলবুলি-বউ কাঁদছে। সে কান্না যেন আর থামে না। কত কষ্ট আর কত ধকল সয়ে সারা দিন পর ঘরে ফিরেছে। এমন সময় কান্নাকাটি কারইবা ভালো লাগে!। বাবা পাখিটার তখন মন মেজাজ গেল বিগড়ে। খাবার দাবার জায়গামত রেখে বউকে জিজ্ঞেস করল, কান্নাকাটির কারণ কী?
মা-পাখিটা তখন সব খুলে বলে বাবা-পাখিকে। কেমন করে কুচ্ছিত কাকটা তেড়ে এসেছিল তার দিকে। কীভাবে তার কাছ থেকে নিষ্ঠুরের মতো গানটাকে চুরি করল। একটুও মায়াদয়া দেখায়নি কাকটা। কাকটা গান চুরি করে পালিয়েছে। এখন আমি কী গান শুনিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াব?
এত সাহস কাকের ! বাবা-পাখি রেগে যেন অস্থির। হাতের কাছে পেলে এখুনি যেন খুন করে ফেলবে কাকটাকে। সাঁই করে বেরিয়ে পড়ল কাকের উদ্দেশে। অনেক খোঁজাখুঁজি করল। এদিকে-সেদিকে ছুটে গেল। পাহাড় পেরিয়ে গেল। প্রান্তর পেরিয়ে গেল। খাঁড়ির দিকে গেল।
বাবা পাখির মন খুব খারাপ। তাদের এত আদরের ছানাদুটিকে মায়ের গান শোনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নাম না জানা হাজার হাজার পাখি এই গ্রীষ্মকালে টেকনাফের এই পাহাড়ে এসেছে। সব পাখিগুলোকে দেখা যায় কিন্তু কাকটাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
এক সময় বাবা বুলবুলিটা এক ঝাঁক দাঁড়কাককে দেখল। কী যেন বলাবলি করছে একজোট হয়ে দাঁড়কাকগুলো। সেখানেও দেখা মিলল না কাকটার। আবার উড়ে-উড়ে চলল বাবা পাখিটা। এদিক তাকায়। আবার ওদিক তাকায়। হঠাৎ দেখতে পেল সেই কাকটাকে। চোখ বুজে সে গান গাইছে।
ছোট্ট দুটি সোনামণির
জোর বেড়েছে পায়ের,
তারা এখন শুনবে কেন
নিষেধ বাবা-মায়ের।
তাদের পিঠের দুদিক থেকে
বের হয়েছে ডানা
তাই তো তারা শুনছে না আর
কারও নিষেধ-মানা।
চোখে-মুখে সারাটা দিন
দুষ্টুমি আর হাসি
বুদ্ধি ভরা মাথা তাদের
তবু ভালোবাসি।
বাবা পাখিটা তখন চিনে ফেলল কাকটাকে। তাহলে এই হলো সেই কাক। গান চুরি করে খোশমেজাজে গান করছে। বুলবুলি-বউয়ের গান চুরি করে গান গাওয়া হচ্ছে পাথরের টিলার ওপর বসে-বসে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! মনে-মনে বাবা-পাখিটা বলল। হঠাৎ বাবা-পাখির একটা বিকট চিৎকার শুনে কাকটা ভয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভরভর করে তার মুখ থেকে তখন বেরিয়ে পড়ল চুরি করা সেই গানটা। বাবা-পাখিটা আর একটুও দেরি করল না। কাকের মুখ থেকে পড়ামাত্রই মুখে তুলে নিল গানটা। ঠোঁটে তুলে নিল সেই চুরি করা গান। চুরি করা নিজেদের গানটা তুলে সোজা বাড়ির দিকে ছুটে চলল বাবা-পাখিটা। এখন যে আর মনে আর কোন দুঃখ নেই। কষ্ট নেই। সে ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া গানটি।
বাড়ি ফিরে গানটা বউয়ের মুখে তুলে দিল। গানটা ফেরত পেয়ে মা-পাখিটা কী খুশি! আনন্দে একেবারে আত্মহারা। বারবার করে সেই গান গাইতে লাগলÑ
ছোট্ট দুটি সোনামণির
জোর বেড়েছে পায়ের,
তারা এখন শুনবে কেন
নিষেধ বাবা-মায়ের।
তাদের পিঠের দুদিক থেকে
বের হয়েছে ডানা
তাই তো তারা শুনছে না আর
কারও নিষেধ-মানা।
চোখে-মুখে সারাটা দিন
দুষ্টুমি আর হাসি
বুদ্ধি ভরা মাথা তাদের
তবু ভালোবাসি।
বাচ্চা সে গান শুনে চুপচাপ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।