ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারের বিধান

খাদেমুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারের বিধান

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসানের পর প্রায় দুইশত বছর চলে ইংরেজ শাসন। তবে ইংরেজ শাসকরা মুসলিম পারিবারিক বিধানের ক্ষেত্রে এ সময়েও ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক প্রথাকে বাতিল করেনি।

সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাদেশেও পারিবারিক বিধান ইসলামী আইন দ্বারাই পরিচালিত হয়ে আসছে। মুসলিম পারিবারিক আইনে যেসব বিধান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুসলিম উত্তরাধিকার ব্যবস্থা।

মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন ১৯৬১ সালে উত্তরাধিকার আইনে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সূরা নিসা এর ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বণ্টনের যে নীতি আছে, তার দ্বারাই মূলত উত্তরাধিকার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এছাড়া সুন্নাহ ও ইজমার ওপর ভিত্তি করে কিছু বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে।

মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনের আগে সেই সম্পত্তি থেকে কিছু দায় আগে মেটাতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে- মৃত ব্যক্তির দাফন সংক্রান্ত ব্যয়ভার মেটানো, মৃত ব্যক্তির কোনো ধার-দেনা তথা ঋণ (স্ত্রীর মোহরানাসহ) থাকলে তা পরিশোধ করা এবং মৃত ব্যক্তি দান ও ওসিয়ত বা উইল করে থাকলে তা সম্পত্তি থেকে মেটানো। তবে উইলের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ মোট সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি হবে না। এসব বিষয় মেটানোর পর বাকি সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন হবে।

মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী কারা:

ইসলামে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে দুটি শ্রেণি রয়েছে। যার মধ্যে প্রথম শ্রেণি হচ্ছে- শেয়ারার বা অংশীদার। এ শ্রেণিতে রয়েছে ১২ জন ওয়ারিশ, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে যাদের অংশ নির্ধারিত। এ শ্রেণির ওয়ারিশরা হচ্ছেন- স্বামী, স্ত্রী, বাবা, মা, দাদা, দাদী, বোন, কন্যা, ছেলের কন্যা, বৈমাত্রেয় বোন, বৈপিত্রেয় ভাই ও বৈপিত্রেয় বোন।

অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছেন রেসিডুয়ারি, আসাবা বা অবশিষ্টভোগী। অবশিষ্টভোগী হয়ে থাকে, প্রথমত, মৃত ব্যক্তির নিজের সন্তান তথা ছেলে ও কন্যা। দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী বংশধর যথা বাবা, দাদা। তৃতীয়ত, বাবার বংশধর তথা ভাই, বোন, বৈমাত্রেয় বোন, বৈমাত্রেয় ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলে, বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের ছেলে। চতুর্থত, দাদার বংশধর তথা চাচা, বৈমাত্রেয় চাচা, চাচার ছেলে, বৈমাত্রেয় চাচার ছেলে, চাচার ছেলের ছেলে, বৈমাত্রেয় চাচার ছেলের ছেলে, আরও দূরবর্তী বংশধর। এ তালিকা থেকে বুঝা যায় স্থান ভেদে একই ধরনের ওয়ারিশ কখনো শেয়ারার বা রেসিডুয়ারি হতে পারে।

ওয়ারিশ/উত্তরাধিকারদের অংশ:

১. স্বামীর অংশ: মৃত ব্যক্তি যদি বিবাহিত নারী হন এবং তার স্বামী জীবিত থাকলে তিনি নির্ধারিত হারে সম্পত্তি পাবেন। সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ছেলে-মেয়ে থাকলে স্বামী পাবেন (১/৪) এক চতুর্থাংশ। অপরদিকে যদি সন্তান না থাকে তবে স্বামীর অংশ হবে মোট সম্পত্তির (১/২) অর্ধেক।

২. স্ত্রী: বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রী রেখে মারা গেলে তার স্ত্রী নির্ধারিত হারে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন। যদি মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকে তবে স্ত্রী পাবেন (১/৮) এক অষ্টমাংশ। আর সন্তান না থাকলে স্ত্রী পাবেন (১/৪) এক চতুর্থাংশ। একাধিক স্ত্রী থাকলেও এ অংশ বাড়বে না বরং স্ত্রীরা সবাই মিলে তাদের অংশ সমভাবে ভাগ করে নেবেন।

৩. বাবা: মৃত ব্যক্তির বাবা সর্বদাই ওয়ারিশ হবেন। তবে অবস্থাভেদে এর পরিমাণে তারতম্য হবে। যদি মৃত ব্যক্তির ছেলে, ছেলের ছেলে এভাবে নিচের দিকে কেউ থাকে তবে বাবা পাবে ১/৬ এক ষষ্ঠাংশ। যদি মৃত ব্যক্তির শুধু কন্যা বা ছেলের কন্যা এভাবে নিচের দিকে কেউ থাকে তবে বাবা ১/৬ এক ষষ্ঠাংশ পাবেন, তবে সেক্ষেত্রে অন্য ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে বাবা সেই অংশও অবশিষ্টভোগী হিসেবে পাবেন। আর যদি মৃত সন্তানের কোনো ছেলে-কন্যা বা ছেলের সন্তান কিছুই না থাকে তবে বাকি ওয়ারিশদের মধ্যে বিতরণ শেষে যা থাকবে তা সম্পূর্ণ পাবেন বাবা।   

৪. মা: মৃত ব্যক্তির মা সর্বদাই ওয়ারিশ হবেন। তবে অবস্থাভেদে এর পরিমাণে তারতম্য হবে। মৃত ব্যক্তির সন্তান বা ছেলের সন্তান এভাবে নিচের দিকে কেউ থাকে অথবা মৃত ব্যক্তির আপন, পূর্ণ বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই-বোন থাকলে মা ১/৬ এক ষষ্ঠাংশ পাবেন। তবে মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান, ছেলের সন্তান এভাবে নিচের দিকে কেউ না থাকলে ও মৃত ব্যক্তির একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকলে মা ১/৩ এক তৃতীয়াংশ পাবেন।

৫. ছেলে-কন্যা: স্বামী/স্ত্রী এবং বা-মার অংশ দেওয়ার পর যা থাকবে তা সম্পূর্ণ মৃত ব্যক্তির ছেলে বা ছেলে, ছেলের ছেলে এভাবে যত নিচেই হোক তারা অবশিষ্টভোগী হিসেবে পাবে। ছেলের সঙ্গে মেয়ে থাকলে প্রত্যেক কন্যা প্রত্যেক ছেলের (১/২) অর্ধেক হারে পাবে। যদি মৃত ব্যক্তির শুধু এক কন্যা থাকে তবে তিনি মোট সম্পত্তির (১/২) অর্ধেক পাবে। আর যদি একাধিক কন্যা থাকে তবে সবাই মিলে (২/৩) দুই তৃতীয়াংশ পাবে।

৬. দাদা: যেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির বাবা জীবিত নাই কিন্তু দাদা আছে, তখন দাদা বাবার ন্যায় ওয়ারিশ হবে। তবে বাবা জীবিত থাকলে দাদা কোনো অংশ পাবেন না।

৭. দাদী/নানী: যেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মা জীবিত থাকবে সেক্ষেত্রে দাদী ওয়ারিশ হবেন না। তবে মা জীবিত না থাকলে দাদী (১/৬) অংশ পাবেন।

৮. আপন বোন এবং বৈমাত্রেয় বোন: যখন মৃত ব্যক্তির ছেলে, ছেলের ছেলে এভাবে নিচের দিকে এবং কন্যা, ছেলের কন্যা এভাবে নিচের দিকে কেউ এবং আপন ভাই ও বাবা, কেউ না থাকে, তবে আপন বোন নিজ কন্যার অনুরূপ অংশ পাবে। এমতাবস্থায় আপন বোন না থাকলে বৈমাত্রেয় বোন আপন বোনের অনুরূপ অংশ পাবে।

৯. সহোদর ভাই-বোন: এ ক্ষেত্রে ছেলে, ছেলের ছেলে এভাবে যত নিচেই হোক কেউ থাকলে অথবা বাবা, দাদা বা এভাবে ঊর্ধ্ব পুরুষ কেউ থাকলে তখন ভাই-বোন কেউ অংশ পাবেন না। তবে যদি স্বামী/স্ত্রী, কন্যা বা মা থাকে তবে তাদের অংশ দেওয়ার পর বাকি অংশ ভাই-বোন নিজেদের অংশ (১/২) হিসেবে পাবে। ঊর্ধ্ব পুরুষ বা উত্তর পুরুষে কেউ না থাকলে সহোদর ভাই-বোন ছেলে-মেয়ের মতো হারে অংশ পাবে।

১০. বৈপিত্রেয় ভাই/বোন: বাবা থেকে কোনো পূর্বপুরুষ এবং ছেলে থেকে নিচের দিকে কোনো উত্তরসূরি না থাকলে বৈপিত্রেয় ভাই বা বোন ১/৬ অংশ পাবে।

উল্লেখ্য, মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বেই যদি তার কোনো সন্তান মারা যায় এবং সেই সন্তানের যদি জীবিত উত্তরাধিকারী থাকে, তবে তারাও সন্তান জীবিত থাকলে যে হারে সম্পত্তি পেতেন তার সমহারে অংশীদার হবে। ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইনে এই বিধান করা হয়। তার আগে মৃত সন্তানের ওয়ারিশগণ অংশ থেকে বঞ্চিত হতো। এছাড়া মৃত ব্যক্তির কোনো জীবিত সন্তান না থাকলে ছেলের কন্যা বা কন্যারা নিজ কন্যার অনুরূপ অংশ পাবেন। কোনো সন্তানকে ত্যাজ্য করা হলেও সে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে না। তবে জীবিত অবস্থায় বাবা কাউকে রেজিস্ট্রি করে দান বা হস্তান্তর করে গেলে সন্তান আর অংশ পাবে না। সৎ ছেলে-মেয়ে সৎ বাবা-মায়ের এবং সৎ বাবা-মা সৎ সন্তানের অংশ পাবে না। স্বামী জীবিত অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দিলে স্ত্রী অংশ পাবে না।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।