ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

নির্বাচন একতরফা হয়নি: সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৩
নির্বাচন একতরফা হয়নি: সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি

ঢাকা: হট্টগোল, হামলা, ভাঙচুর, মামলা, সাংবাদিক পেটানো, প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ ও ধাক্কাধাক্কির মধ্যে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী নির্বাচন ‘একতরফা হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির।

তিনি বলেছেন, আইনজীবীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন।

আর বিএনপি সমর্থিতরা ভোট বর্জনের ঘোষণাও দেননি।

রোববার (১৯ মার্চ) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি। এসময় সমিতির সম্পাদক আবদুন নূর দুলালসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিত কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য তিনি বিএনপির গণতন্ত্রবিরোধী, ভোটবিরোধী, নির্বাচন বিমুখ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন ও মো. রুহুল কুদ্দুসকে দায়ী করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলা হয়।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, প্রচলিত বিধান অনুযায়ী ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান এবং সম্পাদক মো. আবদুন নূর দুলাল সমিতির কনফারেন্স রুমে বসে ব্যালট পেপার স্বাক্ষর করছিলেন। হঠাৎ করে দরজা ধাক্কা দিয়ে বহিরাগত লোকজনসহ সন্ত্রাসী কায়দায় এ.এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং রুহুল কুদ্দুস কাজল কনফারেন্স রুমে ঢুকে আহ্বায়ককে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। টেবিলের ওপরে থাকা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে কিছু ছিঁড়ে ফেলেন এবং কিছু নিয়ে যান। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন এবং ন্যক্কারজনক।

এছাড়া ব্যালট পেপার তছনছ করেন এবং পায়ে মাড়িয়ে দলিত মথিত করেন এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং রুহুল কুদ্দুস কাজল। ফলে নির্বাচনের আগের রাতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।  

নির্বাচনের দিন বিএনপিপন্থীরা ভাঙচুর চালিয়েছেন উল্লেখ করে বলা হয়, ভোটগ্রহণ শুরুর চেষ্টা করলে এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং রুহুল কুদ্দুস কাজলের নেতৃত্বে অনেক বহিরাগত সন্ত্রাসী প্যান্ডেলে ঢুকে পড়েন ও ব্যাপক ভাঙচুর চালান। অনেক আইনজীবীকে আহত করেন। তারা ভোট বর্জন করেছেন কিনা সেটাও জানাননি। তাদের বিকল্প প্রস্তাব কী তাও জানাননি। তারা এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

ভোটগ্রহণ বিলম্বিত হতে থাকে এবং একটানা ভাঙচুর চলতে থাকে। এ অবস্থায় ভোটগ্রহণ শুরু ও সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ ব্যতীত কোনো বিকল্প অবশিষ্ট ছিল না।

ইতোপূর্বে সব নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়। বর্তমান নির্বাচনেও পদত্যাগকারী আহ্বায়ক মো. মুনসুরুল হক চৌধুরী সহায়তা চেয়ে চিঠি দেন। এমনকি প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করেন।

সাংবাদিকদের বিষয়ে বক্তব্যে বলা হয়, দুই দিন দায়িত্ব পালনকালে ঘটনার আকস্মিকতায় আপনারা কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সামগ্রিক দায়ভার বিএনপির গণতন্ত্রবিরোধী, ভোটবিরোধী, নির্বাচন বিমুখ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। সামগ্রিক বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সংযম, দায়িত্বশীলতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের পরিচয় দিয়েছি।

এর আগে দুই দিনব্যাপী নির্বাচনের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) দিবাগত রাতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে ১৪টি পদের সব কটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছেন।

যদিও নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল বিএনপি সমর্থকরা।

নির্বাচিত হলেন যারা
আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাদা প্যানেলের প্রার্থী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির তিন হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে সভাপতি ও মো. আবদুন নূর দুলাল তিন হাজার ৭৪১ ভোট পেয়ে সম্পাদক পদে পুর্ননির্বাচিত হয়েছেন।

সহ-সভাপতির দুটি পদে মো. আলী আজম ও জেসমিন সুলতানা, কোষাধ্যক্ষ পদে এম মাসুদ আলম চৌধুরী, দুটি সহ-সম্পাদক পদে এ বি এম নূর-এ-আলম উজ্জ্বল ও মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ জয়ী হয়েছেন।

সাতটি সদস্য পদে জয়ীরা হচ্ছেন- মহিউদ্দিন আহমেদ (রুদ্র), মনিরুজ্জামান রানা, শফিক রায়হান শাওন, মো. সাফায়েত হোসেন (সজীব), মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. নাজমুল হুদা ও সুভাষ চন্দ্র দাস।

সমিতির দক্ষিণ হলে নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত উপ-কমিটির আহ্বায়ক মো. মনিরুজ্জামান ফলাফল ঘোষণা করেন।

দুই দিনব্যাপী নির্বাচনে ভোটার ছিল আট হাজার ৬০২ জনের মধ্যে ভোট পড়েছে চার হাজার ১৩৭টি।

এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্ত থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগপন্থীরা দ্বিমুখী অবস্থানে ছিল। প্রথমেই দুই পক্ষ দুটি নির্বাচন উপ-কমিটি ঘোষণা করে। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়রদের বৈঠকের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুনসুরুল চৌধুরীকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। উভয় পক্ষ এ কমিটিকে মেনে নেয়। কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন তার পদত্যাগের খবর আসায় সংকটের সৃষ্টি হয়। ফের দুই পক্ষ দুটি কমিটি গঠনের কথা জানায়।

আওয়ামীপন্থীরা মো. মনিরুজ্জামানকে ও বিএনপিপন্থীরা এ এস এম মোক্তার কবির খানকে আহ্বায়ক করেন।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের প্রথম দিনের ভোট চলাকালে সাদা (সরকার সমর্থক) ও নীল (বিএনপি সমর্থক) দলের দিনভর দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হাতাহাতি, হামলা, ভাঙচুর ও পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। এতে আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।  

বুধবার (১৫ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু করার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের হট্টগোল, হাতাহাতিতে ভোট শুরু হয় দুপুর পৌনে ১২টায়। প্রথম দিনে দুই হাজার ২১৭টি ভোট পড়ে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরা ভোট দেননি।  

তবে বুধবার সকাল ১০টায় ভোটগ্রহণের সময় বিএনপি সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা ভোটকেন্দ্র দখলে নিয়ে সেখানে বিক্ষোভ করতে থাকেন। নতুন করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনের দাবি তোলেন তারা। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রেই বিক্ষোভ করতে থাকেন তারা। এরপর আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীরাও ভোটকেন্দ্রে ঢুকলে শুরু হয় হট্টগোল। এক পর্যায়ে শুরু হয় হাতাহাতি। এ সময় শতাধিক পুলিশ ভোটকেন্দ্রে ঢুকে লাঠিপেটা শুরু করে। ভোটকেন্দ্রের বাইরেও আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে উত্তাপ ছড়ায়।  

এ সময় পুলিশের লাঠিপেটার সময় ভোটকেন্দ্রের ভেতরে থাকা সাংবাদিকদের ওপরও চড়াও হয় পুলিশ। সাংবাদিকদের এলোপাতাড়ি লাঠিপেটা শুরু করে পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক গুরুতর আহত হন।

এ ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্ট বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের (এলআরএফ) সভাপতি আশুতোষ সরকার ও সাধারণ সম্পাদক আহাম্মেদ সরোয়ার হোসেন ভূঞার নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বিষয়টি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে জানান। তখন প্রধান বিচারপতি লিখিত অভিযোগ নিয়ে যেতে বললে পরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। লিখিত অভিযোগের পর প্রধান বিচারপতি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

এলআরএফ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশন, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।

বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ভোটগ্রহণের মধ্যে বুধবার বিকেল সোয়া ৩টায় সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে জড়ো হয়ে সাংবাদিকদের সামনে নির্বাচন পরিস্থিতি তুলে ধরেন।  

সেখান থেকে মিছিল করে এসে নির্বাচনী প্যান্ডেল, আইনজীবীদের বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করেন তারা। এক পর্যায়ে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিকেল প্রায় সোয়া ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। পরে শুরু হয়ে ৫টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ।  

এ নিয়ে এ পর্যন্ত বিএনপিপন্থীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় তিনটি মামলা হয়।

বিএনপিপন্থীদের দাবি সাধারণ আইনজীবীদের ডেকে সবার মতামত নিয়ে নতুন করে ভোটগ্রহণ করতে হবে। তা না হলে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার পর থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে শেষ দিনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিএনপিপন্থীরা ভোটে না গিয়ে প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হন। এরপর প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে ডাকেন।  

আলাদাভাবে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, বারের দুজন সাবেক সম্পাদক গিয়েছিলেন কথা বলতে। যারা বর্তমানে সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী। প্রধান বিচারপতি বলেছেন- আমি ওনাদের বলেছি, যেহেতু এটা বারের বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। প্রধান বিচারপতির এখানে করার কিছু নেই। আপনারা বারের সিনিয়র যারা আছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করে সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে করেন। পরিবেশ সবাই মিলে সঠিক রাখার চেষ্টা করেন। এটা প্রাইভেট সংগঠন। বার অ্যাসেসিয়েশনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই।

এদিনও দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।

এর মধ্যে এ ঘটনায় করা পৃথক মামলায় কয়েকজন আইনজীবী আগাম জামিন নিয়েছেন। আর আটক হয়েছেন এক আইনজীবী।

বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৩
ইএস/এমএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।