ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

চমেকে ভর্তি হতে ৪৩ বছরের যুদ্ধ শেষ হলো সলিলের

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩০ ঘণ্টা, মে ৫, ২০২৩
চমেকে ভর্তি হতে ৪৩ বছরের যুদ্ধ শেষ হলো সলিলের

ঢাকা: বান্দরবান সদরের সারদা চরণ চক্রবর্তীর ছেলে সলিল কান্তি চক্রবর্তী ১৯৭৬ সালে এসএসসি ও ১৯৭৮ সালে এইচএসসি পাশের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ১৯৭৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির আবেদন করেন। প্রয়োজনীয় সব শর্তপূরণ করার পর তিনি ওই কোর্সে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন।

কিন্তু মেডিকেল কলেজের বাছাই কমিটি সলিল কান্তি চক্রবর্তীর এসএসসি-এইচএসসির নম্বরপত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জাল উল্লেখ করে তাকে তাকে ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়।

সেই থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দৌড়াদৌড়ি শুরু সলিল কান্তির। কিন্তু কোনো প্রতিকার তো পাননি। উল্টো তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর অনুসন্ধানের পর সলিল কান্তির বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে বান্দরবানে মামলা করে পুলিশ। সেই মামলা থেকে খালাস পেয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাননি সলিল কান্তি।

পরে তিনি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। ২০০৭ সালে হাইকোর্ট তাকে ভর্তির নির্দেশ দেন। আর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান রাষ্ট্রপক্ষ।  

বুধবার (০৩ মে) আপিল বিভাগ সেই আপিল খারিজ করে দেন। আর খরচা হিসেবে সলিল কান্তিকে দুই কোটি টাকা দিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেন বলে জানিয়েছেন সলিল কান্তির আইনজীবী।

আদালতে সলিল কান্তির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

আইনজীবী সূত্রে জানা যায়, সলিল কান্তির ভর্তির আবেদন বাতিল করে ভর্তি প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করে বাছাই কমিটি। এরপর সলিল কান্তি চক্রবর্তী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির জন্য বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকের দপ্তরে কাছে আবেদন করেন।

এক পর্যায়ে ১৯৮৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে চিঠি দিয়ে জানায়, তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে তদন্তাধীন। সংস্থাটি সিদ্ধান্ত জানালে তার ভর্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।  

কিন্তু নম্বরপত্রসহ ভুয়া কাগজপত্র তৈরির অভিযোগে ১৯৯৪ সালে বান্দরবান থানায় মামলা করা হয়। মামলায় তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৪৬৮ ও ৪৭১ ধারার অভিযোগ আনা হয়। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পেতে এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরপত্রসহ অন্যান্য শিক্ষা সংশ্লিষ্ট জাল কাগজপত্র তৈরির অভিযোগ করা হয় মামলায়।

বিচার শেষে ২০০০ সালের ২১ আগস্ট বান্দরবানের অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মোকসেদ আলী মামলার অভিযোগ থেকে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে বেকসুর খালাস দেন। তবে তার ভর্তির বিষয়ে কিছু বলেননি রায়ে। এ রায়ের পর ২০০১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সলিল চক্রবর্তীর ভর্তির সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই পরিচালক স্বাস্থ্য সচিবকে তিনবার চিঠি দেন।

তাতে কাজ না হওয়ায় ২০০৩ সালের ২৪ জুন সলিল কান্তি চক্রবর্তী মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য এক প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেন। একের পর এক এমন আবেদনের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সালিলের ভর্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেন। তারপরও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ওই বছর ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে আবেদন করেন সলিল।

তাতেও কাজ না হওয়ায় ২০০৫ সালের ১৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিস পাঠান সলিল কান্তি। নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে তার ভর্তির পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়। এতে সাড়া না পেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।

রিটের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট সলিল কান্তি চক্রবর্তীর ভর্তি নিয়ে ২০০৬ সালের ২৫ জুন রুল জারি করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০০৫-০৬) তাকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি করতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং তার ভর্তির ক্ষেত্রে বিবাদীদের ইচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্য তাকে কেন আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। চূড়ান্ত শুনানির পর ২০০৭ সালে ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে রুল যথাযথ ঘোষণা করার পাশাপাশি তাকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি করাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ওই বছরই হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই আবেদনের শুনানির পর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। রায় স্থগিত থাকা অবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে আপিল খারিজ করে রায় দিলেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে মামলার খরচ হিসেবে হিসেবে সলিল কান্তি চক্রবর্তীকে দুই কোটি টাকা দিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।

আইনজীবী আরো জানান, কত দিনের মধ্যে অধ্যক্ষের কাছ থেকে এই টাকা আদায় হবে সেটা জানতে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তবে ষাটোর্ধ্ব সলিল কান্তি আপাতত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০২৩
ইএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।