ঢাকা: একটি ছিনতাই মামলার আসামিদের শারীরিক নির্যাতন করে আহত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) রাসেল মনির ও সদ্য প্রত্যাহার হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে তলব করেছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে উচ্চ আদালতের জামিনাদেশ থাকার পরও আসামিদের জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করা হয়েছে।
আগামী ১৬ জুলাই তাদেরকে সশীররে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
ওই আসামিদের আইনজীবী বিষয়টি আদালতে উপস্থাপনের পর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শক ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদারকান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিনে নেন। জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান।
ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০-১২ পুলিশ সদস্য।
আইনজীবী মুজিবুর রহমান জানান, ২৯ মে তিন আসামি ৬ সপ্তাহের জামিন দেন। পরদিন ৩০ মে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়, মারধর করা হয়, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ব্যাপারী এ সময় উপস্থিত ছিল। পরদিন থানায় নিয়ে এসে আসামিদের বাবার কাছ থেকে ৭২ লাখ টাকার চেক লিখে নেয় এবং নওডোবা বাজারে দুইটা দোকান লিখে দিতে বলে। এরপরও পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি। আসামিরা যখন পানি চায় তখন এক আসামির প্রস্রাব আরেকজনকে খাওয়ায়। পরে ১ জুন তাদের চিফ জুডিসিয়াল কোর্টে উপস্থাপন করা হয়। উচ্চ আদালতের আদেশ থাকায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে জামিন দেওয়া । এটা না করে তিনি কারাগারে পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিষয়টি আজকে নজরে আনার পর দুই পুলিশ অফিসার এবং চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি পুলিশের মহাপরিদর্শক ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা ও তাদের বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা এসপির কাছে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মোহাম্মদ বদিউজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের মামলা সূত্রে জানা গেছে, ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আলম শেখ (২০) ও সেকেন্দার মাদবরকে (৫১) জোর করে নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় স্থানীয় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চৌকিদারসহ ১০-১১ জন। ডলারসহ যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা ধরা হয়েছে।
এ ঘটনায় ২৩ মে শাহীন আলম শেখ বাদী হয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় সাদ্দাম, বকুলসহ নয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৫-৬ জনকে আসামি করে একটি ছিনতাই মামলা করেন। তবে শাহীন আলম ও সাদ্দাম চোকদারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শত্রুতা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
এদিকে মেডিকেল প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, ৪ জুন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান চার আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ আঘাতগুলো কীভাবে করা হয়েছে, তা বলতে পারবেন না।
মেডিকেল প্রতিবেদনে নির্যাতনের সত্যতা পেয়ে শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান তা আদালতে নথিভুক্ত করেন। এরপর তিনি ৭ জুন এ বিষয়ে আদেশ দেন। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩’–এর ৫ ধারার বিধান অনুযায়ী অভিযুক্ত নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর ৯ জুলাইয়ের মধ্য আমলি আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ সুপার শরীয়তপুরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে ২১ মে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মোবাইলফোন ছিনতাই হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তাতে ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা খোয়া গেছে এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এতে বকুল চোকদার, সাদ্দাম চোকদার, সাইদুল শেখ, আনোয়ার হোসেনসহ নয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
২৯ মে তারা উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তারা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় ছিলেন। সেখানে তাদের ওপর চড়াও হন জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল ও ছিনতাই মামলার বাদীর আত্মীয় শহীদুল ইসলাম। পরে রুবেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে ফোনে কেরানীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানে একটি কক্ষে আটকে তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
এ ব্যাপারে জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারী বলেন, যার ডলার ও টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি তার ভাগনে হয়। তাকে সহযোগিতা করার জন্য সামাজিকভাবে তিনি মামলার আসামিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ঢাকায় তাদের অনুসরণ করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তখন ধস্তাধস্তিতে তারা ব্যথা পেতে পারেন।
আরও পড়ুন>>>
শরীয়তপুরে ২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০২৩
ইএস/এএটি