খুলনা: খুলনার বহুলালোচিত আট বিয়ে করা সুলতানা পারভীন নীলা ওরফে বৃষ্টি ও তার কাজী আবু সালেহ মোহাম্মদ নুরুল হকের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) ওই নারীকে অভিযুক্ত হিসেবে গণ্য করে দণ্ডবিধির ৩২৩, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ৩৮৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করেছেন অতিরিক্ত প্রথম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সুলতান সোহাগ উদ্দিন।
বিষয়টি বাদীপক্ষের ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী ওয়াদুদ শাহীন নিশ্চিত করে বলেন, ২০২২ সালে নীলার সপ্তম স্বামী এম রহমানের দায়ের করা মামলার তদন্ত ভার অর্পণ করা হয় ঢাকার সিআইডি পুলিশের ওপর।
সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে আসামিদের নামে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ওই বছরে আদালতে চার্জশিট দেন। বুধবার উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি শেষে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে আদালত নিশ্চিত হওয়ায় সুলতানা পারভীন নীলা ও কাজী আবু সালেহ মো. নুরুল হকের নামে অভিযোগ গঠন করে। অপর দুই আসামির নামে সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
কাবিন জালিয়াতি করে বিয়ে ও প্রতারণার মাধ্যমে চেক নেওয়ার মামলার জন্য সুলতানা পারভীন নীলার নামে এ চার্জ গঠন করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সৌন্দর্যকে পুঁজি করে প্রতারণার মাধ্যমে নাম পাল্টিয়ে এবং কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রায় ১০টি বিয়ে করেছেন তিনি। আর সবগুলোই ছাড়াছাড়ি করেছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। প্রতারণার দায়ে জেলও খেটেছেন তিনি।
মামলার এজাহার এবং স্থানীয় সূত্রে গেছে, সুলতানা পারভিন ওরফে নীলা জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী এটিই তার নাম। যদিও তিনি প্রতারণার জন্য কখনো নিজেকে সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি, কখনো রুমাইনা ইয়াসমিন রূপা, নাজিয়া শিরিন শিলা, স্নিগ্ধা আকতার নামেও পরিচয় দেন। নিজের সৌন্দর্য এবং কথার জালে আটকান প্রবাসী, ধনী এবং ব্যবসায়ীদের। নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে আটটি বিয়ের করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব বিয়েই ছাড়াছাড়ি হয়েছে বিয়ের অল্প কিছু দিনের মধ্যে। মামলার ভয় দেখানোসহ বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিয়ে কৌশলে টাকা, বাড়ি নিয়েছেন নিজের করে। এসব স্বামীদের করেছেন সর্বস্বান্ত। বার বার বিয়ে করা এবং অর্থ সম্পদ নিয়ে ছাড়াছাড়ি মতো প্রতারণাই এই সুন্দরী নারীর মূল পেশা। তার এই প্রতারণা পেশার প্রধান সহকারী তার ভাই এবং পরিবার। গতবছর এমন প্রতারণা করতে গিয়ে সাবেক এক স্বামীর করা মামলায় জেলও খেটেছেন তিনি। বিয়ে ছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড। সরকারি আমলা, রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে রয়েছে তার উঠাবসা।
১৯৯৯ সালে ১৫ বছর বয়স তার প্রথম বিয়ে হয় মাদারীপুরের হরিকুমারিয়া গ্রামের আব্দুল হাকিম শিকদারের জাপান প্রবাসী ছেলে শাহাবউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে। তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালামাল চুরির ঘটনায় মাদারীপুর সদর থানায় একটি জিডি করেন শাহাবউদ্দিন। এর নম্বর ৭৩৮, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯। পরে ২০০১ সালে শাহাবউদ্দিনের সঙ্গে বৃষ্টির বিচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০০৫ সালে এসএম মুনির হোসেনের সঙ্গে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে বিয়ে করেন খুলনা নগরের খালিশপুর এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে ঠিকাদার মইনুল আরেফিন বনিকে। নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় বৃষ্টির নামে মামলা করেন স্বামী বনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি করা হয়। তবে যথারীতি টাকা আদায় করতে বনির বিরুদ্ধেও খুলনার বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা করেন বৃষ্টি। বনির সঙ্গে মামলা চললেও ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জের ইফতিখার নামে আরেকজনকে বিয়ে করেন। পরে ২০১২ সালে বিয়ে করেন বাগেরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসেনকে। ২০১৭ সালে ইতালি প্রবাসী মাদারীপুরের মোহাম্মদ আজিমকে, ২০১৮ সালে খুলনার ডুমুরিয়ার মোহাম্মদ রহমানকে এবং ২০১৯ সালে খুলনা মহানগরের নাজির ঘাট এলাকার মো. আব্দুল বাকীকে বিয়ে করেন। আট নম্বর স্বামী মো. আব্দুল বাকীর সঙ্গে প্রতারণা করায় বৃষ্টির বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে চেক ও টাকা-পয়সা চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়। এছাড়া সিরাজগঞ্জে থাকার সময় ঢাকার একটি ফ্ল্যাট নিজের নামে লিখে না দেওয়ায় আরেক স্বামীকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো হয়। ওই ঘটনায় প্রতারক বৃষ্টির নামে ২০১৯ সালের ২ মে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় জিডি করা হয়।
২০২১ সালে জানুয়ারিতে খালিশপুরে আফরীন আহমেদ নামে এক আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন থাকেন সুলতানা বৃষ্টি। সেই সুযোগে আত্মীয়ের বাসা থেকে একটি চেকের পাতা চুরি করে অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন। ওই ঘটনায় তার নামে জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাটি এখন পিবিআই খুলনা কার্যালয়ে তদন্তাধীন।
এভাবে প্রতিটি বিয়ে করেছেন নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে। বিয়ের পর মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে স্বামীদের কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা। বৃষ্টির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুই স্বামী মারাও গেছেন। খুলনা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের অনুমোদিত তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুলতানা পারভীনের নিকাহ রেজিস্ট্রিকারী মাওলানা এএসএম নুরুল হক। যিনি বৈধ নিবন্ধিত নিকাহ রেজিস্ট্রার নয়। এই ভুয়া নিকাহ রেজিস্টার দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে পবিত্র কাজটি করতেন তিনি। বিয়ের পর সংসার চালানো, নিজের খরচ, দেনমোহর ও স্বামীর থাকা ফ্ল্যাট নিজের নামে করতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন নীলা।
ঠিকাদার মইনুল আরেফিন বনিকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে বিয়ে করায় বৃষ্টির নামে মামলা করেন স্বামী বনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলাটি করা হয়। মামলাটি তদন্তাধীন ছিল। এরমধ্যে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে আদালতে। চলতি বছরের নভেম্বরে আদালতে হাজির না হওয়ায় সমন জারি করে আদালত।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
এমআরএম/এএটি