ঢাকা: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা উদ্দেশে অপহরণের মামলায় আসামি শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগকৃত তিনটি মোবাইল সেট পুকুরে ফেলে দেন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু। সে মোবাইল ফোন উদ্ধারে অভিযানের জন্য তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
সোমবার (২৪ জুন) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন৷ একই সঙ্গে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে ঝিনাইদহ কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বাবুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য ডিবিকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন আদালত।
রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলার তদন্তে জানা যায় ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনারকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ ও হত্যার মূল ঘাতক শিমুল ভুইয়ার জব্দকৃত মোবাইল সেট পর্যালোচনায় পাওয়া যায় যে, শিমুল ভূইয়া গত ১৫ মে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসে এবং ১৬ মে রাতে কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে অপহরণ ও হত্যা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলে।
পরবর্তীতে শিমুল ভুইয়া ও গ্যাস বাবু ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় সাক্ষাৎ ও মিটিং করে ভিকটিম এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের ছবি বিনিময় করে। এছাড়াও ১৭ থেকে ১৯ মে রাত পর্যন্ত শিমুল ভুইয়ার সঙ্গে কাজী কামাল আহমেদ বাবুর হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়, এসএমএস আদান-প্রদান হয় এবং ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনার অপহরণ ও পরবর্তী টাকা পয়সা সংক্রান্তে কথাবার্তা হয়।
আবেদনে আরও বলা হয়, উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তার করে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে, সে ঘাতক শিমুল ভুইয়ার সঙ্গে ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনার অপহরণ ও হত্যা সংক্রান্তে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ, ছবি আদান প্রদান ও এসএমএস আদান প্রদানের কথা স্বীকার করে।
শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করার মোবাইল সেটগুলো কোথায় এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বাবু জানান, তার মোবাইল সেটগুলো হারিয়ে গেছে এবং এ বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ওই আসামি গত ১৪ জুন ওই মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
জবানবন্দিতে বাবু স্বীকার করেন, আসামি শিমুল ভূইয়ার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগকৃত মোবাইল সেট তিনটির মধ্যে দুইটি গাঙ্গুলী হোটেলের পেছনের পুকুরে এবং একটি স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়। ওই মোবাইল সেটগুলোতে ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনার অপহরণ ও হত্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে বিধায় মোবাইল সেটগুলো প্রয়োজন। তাই মোবাইল সেটগুলো কোন কোন স্থানে ফেলেছে সেই স্থান নির্ধারণসহ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত মোবাইল সেটগুলো উদ্ধারের জন্য হাজতি আসামিকে সঙ্গে নিয়ে ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করার জন্য আসামি কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন।
বাবুর পক্ষে আইনজীবী এ.এস.এম আবুল কাশেম খান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, গত ৬ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঝিনাইদহ থেকে ডিবি পুলিশ তুলে নেয়। এ সময় তার সন্তানকে জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সকালে দিয়ে যাবে। এরপর থেকে তারা আর যোগাযোগ করেনি। পরে তাকে সায়দাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় ডিবি পুলিশ। এরপর তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। আর যে মোবাইলের কথা বলা হচ্ছে, সেটার সঙ্গে মামলার সংশ্লিষ্টতা নেই। ডিবি পুলিশের সাজানো ‘কথা না বললে সন্তানদের মেরে ফেলার’ হুমকি দিয়ে তাকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।
শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করেন। একইসঙ্গে তাকে ঝিনাইদহ কারাগারে পাঠানোর জন্য কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারকে নির্দেশ দেন। সেখান থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বাবুকে নিয়ে মোবাইল উদ্ধারে অভিযানের নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে গত ৯ জুন গিয়াস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন অপর একটি আদালত। সেই রিমান্ড চলাকালে গত ১৪ জুন তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে গত ৬ জুন রাতের ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে আটক করে ঢাকা থেকে আসা ডিবির একটি দল। এরপর এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
এ মামলায় আগে গ্রেপ্তার তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। এর মধ্যে গত ৩ জুন আসামি শিলাস্তি রহমান, ৪ জুন তানভীর ভূঁইয়া এবং ৫ জুন সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
গত ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশে অপহরণের অভিযোগে মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের বাসায় আমরা সপরিবারে বসবাস করি। গত ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা আনোয়ারুল আজীম আনার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। গত ১১ মে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাই।
গত ১৩ মে বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে উজির মামার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে। এতে লেখা ছিল, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি রয়েছে। আমি অমিত সাহার কাজে নিউটাউন যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। আমি পরে ফোন দেব। ’
এছাড়া আরও কয়েকটি বার্তা আসে। ক্ষুদে বার্তাগুলো আমার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজ করতে থাকি। কোনো সন্ধান না পেয়ে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস বাদী হয়ে ভারতীয় বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপরও আমরা খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি।
পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে বাবাকে অপহরণ করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৩ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২৪
কেআই/জেএইচ