ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

হরতাল নিয়ে আইন কি বলে?

ইলিয়াস সরকার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫
হরতাল নিয়ে আইন কি বলে? ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হরতালের নামে জ্বলছে দেশ, পুড়ছে মানুষ। সংবিধানের দোহাই দিয়ে মৌলিক অধিকারের নামে অগণতান্ত্রিক এ আচরণ বন্ধ চায় ‘গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা পর্ষদ’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন।

অহিংস তথা ‘গণতান্ত্রিক’ হরতাল পালনে সম্প্রতি তারা ‘হরতাল এর নীতিমালা ও আইনি বিধান প্রণয়ন’ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবনা আইন কমিশনে পেশ করেছে।

এ প্রস্তাব নিয়ে তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে ১ম কিস্তি।

ঢাকা: বিশ্বজুড়ে হরতাল-বনধ একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভাষা হলেও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এটা একটি উদ্বেগ, আতঙ্ক আর পেট্রোল বোমায় ঝলসানোর প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান, উচ্চ আদালত এবং আইনের বিভিন্ন ধারা দেখিয়ে ‘মৌলিক অধিকার’ নাম দিয়ে হরতালের ডাক দেওয়া হয়।

‘গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা পর্ষদ’ নামের এ সংগঠনটি তাদের প্রস্তাবে হরতালের আইনি বিষয়গুলো তুলে ধরেছে।

প্রস্তাবে বলা হয়, ‘হরতাল মৌলিক অধিকার। এ অধিকার পালনে কোনো অবস্থাতে অন্য কারো মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না। আন্তর্জাতিক ঘোষণাগুলোতে যে সকল মৌলিক অধিকার আছে তা পালন করতে হবে আইনানুগ ও শান্তিপূর্ণভাবে’।

দি ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস (১৯৪৮), ইন্টারন্যাশনাল কভোনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (১৯৭৬) ও ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস (১৯৫০) মতে, ‘মৌলিক অধিকার পালনে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে মৌলিক অধিকার পালন করতে অন্যের অধিকার খর্ব করা যাবে না’।

কানাডার দণ্ডবিধিতে রয়েছে, ‘বেআইনিভাবে বা প্রচলিত আইন অমান্য করে যেকোনো মৌলিক অধিকার পালন দণ্ডযোগ্য অপরাধ’।

অস্ট্রেলিয়ান সংবিধানের ২১ ধারা মোতাবেক, ‘অন্যের অধিকার খর্ব করে কেউ তার মৌলিক অধিকার পালন করতে পারবে না’।

আমেরিকা, জার্মানি ভারতসহ সব দেশে এ রকম বিধি-নিষেধ আছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার পালন করা যাবে’।

মৌলিক অধিকারের কথা বলে হরতাল ডাকা হলেও বর্তমান সময়ের হরতালে দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারা অমান্য করা হয়। যেমন সহিংসতা ও পিকেটিং ১৪১ ও ১৪৬ ধারা অনুসারে অপরাধ।

তবে হরতালের সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, সন্ত্রাস বিরোধী আইন-১৯৯২ ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও হরতালের সহিংতায় যারা গ্রেফতার হয় তাদেরকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে মুক্তি দাবি করা হয়।

প্রস্তাবনায় হরতাল নিয়ে উচ্চ আদালতের একটি রায় উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে হরতালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী রায়ে বলেন, ‘(ভাবানুবাদ) কোনো প্রকার ভয়-ভীতি না দেখিয়ে হরতাল ডাকা একটি বৈধ কর্মকাণ্ড এবং সেটা প্রতিবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) (এ)  সংরক্ষিত। এখানে ভয়-ভীতি না দেখিয়ে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি’।

তিনি আরও বলেন, ‘যদি হরতাল আহবান এর সঙ্গে ভয়-ভীতি প্রদর্শন জড়িত থাকে বা হরতাল পালনে কাউকে কোনোভাবে বাধ্য করা হয়, তাহলে হরতাল ডাকা অবৈধ হবে। কারণ সেটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে’।

বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির বলেন, হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। একাধারে যেমন হরতালের পক্ষে কোনো বেআইনি কাজ করা যাবে না, তেমনি হরতাল পালনের বিরোধী কর্মী দ্বারা হরতালের বিপক্ষে বিরক্তি, উসকানি, হস্তক্ষেপ এবং কোনো ধরনের আগ্রাসন করা যাবে না।

এদিকে জাতীয় সংসদে ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মজিবুল হক চুন্নু একটি হরতাল নিয়ন্ত্রণ আইন প্রস্তাব আকারে পেশ করেন। কিন্তু তা পাস হয়নি।

হরতালের ইতিহাস
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন এর বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারতে প্রথম বয়কট কর্মসূচি পালন করা হয়। পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশি আন্দোলনের মধ্যে সত্যাগ্রহ, অনশন, বয়কট, মার্চপাস্ট, বর্জন, অসহযোগ, অবরোধ, মিছিল ইত্যাদি ছিল। এসব আন্দোলন ছিলো অহিংস। এসব আন্দোলনের পরে আসে বনধ বা হরতালের মতো কর্মসূচি।

সিপিডির প্রতিবেদন মতে দেখা যায়, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে হরতাল হয়েছে ৩ দিন, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৭ দিন, ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৭ দিন এবং ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৪৬ দিন।

প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, এখন হরতাল মানে শহরের যেকোনো স্থানে সংঘাত, গাড়ি ভাংচুর, পেট্রোল বোমা, ককটেল, যেকোনো স্থানে বাসে-গাড়িতে আগুন, ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলা, গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি।

কিছুদিন আগে শোনা গেছে, একটি ছাত্র সংগঠন রীতিমতো তালিকা দিয়ে সহিংসতার দায়-দায়িত্ব দাবি করেছে। তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ প্রকাশ্যে এদের দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেন না এবং পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে।

তাহলে প্রশ্ন হলো, কারা এবং কেন সহিংসতা করছে? এই বীভৎস সহিংসতা কি গণতান্ত্রিক অধিকার? রাজনৈতিক অধিকার? যেখানে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সেখানে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতেই হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।