ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

ফতোয়া: উচ্চ আদালতের রায়

আমরিন খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৫
ফতোয়া: উচ্চ আদালতের রায়

গত ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ফতোয়া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারকের বেঞ্চ ফতোয়া সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় প্রদান করেন।



সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিম্নলিখিত রায় প্রদান করেন :
১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
৪. তবে ঐ নির্দিষ্ট ফতোয়াটি (যা হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন) অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো।

ফতোয়ার রায়ের বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। এঁদের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মূল রায় লেখেন। তাঁর সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় দেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

শুনানিতে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরিয়া) হিসেবে টি এইচ খান, রফিকউল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, এ বি এম নুরুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, তানিয়া আমীর এবং এস আই ফারুকীর বক্তব্য শোনেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া পাঁচজন আলেমের বক্তব্যও শোনেন আদালত।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালে নওগাঁ সদর উপজেলার আম্বিয়া ভাঙ্গাপাড়ার সাইফুল কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্ত্রী শাহিদার উদ্দেশে ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। কথাটি প্রতিবেশী মওলানা আলহাজ আজিজুল হক শুনতে পান। কিন্তু এই ঘটনার পর তাঁরা একসঙ্গে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপন করতে থাকেন। ঘটনার এক বছর পর, সাইফুলের অনুপস্থিতিতে মওলানা আজিজুল হক উক্ত তালাকের ঘটনা শরিয়তমতো ‘শুদ্ধ’ করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে জনৈক শামসুলের সঙ্গে শাহিদার হিল্লা বিয়ে দেন। এই ঘটনার পর সাইফুল  শাহিদাকে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আসে। আদালত এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই মামলায় ইন্টারভেনর হয়। ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট ডিভিশন ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে সকল প্রকার ফতোয়া অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এই রায়ে বলা হয়, ‘আইনবহির্ভূতভাবে কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৯০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ঐ বছরই আপিল দায়ের করেন মুফতি মো. তৈয়ব ও মওলানা আবুল কালাম আজাদ। আপিল দায়েরের ১০ বছর পর ২০১১ সালের মার্চ মাসে এর ওপর শুনানি শুরু হয় এবং শুনানি শেষে ঐ বছরের ১২ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত করে রায় ঘোষণা করেন।

আপিলের বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা বলেন যে
১. যে-কোনো প্রকার আইনি বিষয়ে কাউকে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা কোনো ব্যক্তির নেই, কারণ অনুরূপ ক্ষমতা কেবল বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত।
২. ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক তথা সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ৩১, ৩২, ৩৫ এবং ৪১-এ স্বীকৃত অধিকারগুলোর লঙ্ঘন।

২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।

৩১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে-কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩২ নং অনুচ্ছেদ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকারের কথা বলেছে।

৩৫ নং অনুচ্ছেদের ৫ম দফায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারো সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহারও করা যাবে না। ৪১ অনুচ্ছেদ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।
৩. ব্লাস্ট এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ এই মামলাটিতে হাইকোর্ট ডিভিশন পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে কাউকে শাস্তি প্রদান করাকে সংবিধান সমর্থন করে না।
৪. একশ্রেণির ব্যক্তিরা ফতোয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদে একপ্রকার অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর নির্মম শিকার হচ্ছেন গ্রামের নিরীহ নারীরা। যদি এই নারীসমাজকে ফতোয়ার অভিশাপ থেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৫. দেশে প্রচলিত আইন, মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিরুদ্ধে কোনো ফতোয়া দেওয়া যাবে না।
৬. শুধু মতামত আকারে ফতোয়া দেওয়া হলেও যদি সেটি কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তাহলে সেই ফতোয়া অবৈধ হবে।
৭. বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীদের এই বিষয়ে মতভেদ নেই যে, যথাযথভাবে ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিরা ফতোয়া দিতে পারেন ঠিকই কিন্তু এ দেশের সংবিধান তাদের কাউকে ফতোয়া মানতে বাধ্য করা বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করে না।

রায় প্রদানকালে উচ্চ আদালত কিছু কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তা হলো
ফতোয়া কী;
(ইসলামের দৃষ্টিতে) ফতোয়ার অবস্থান;
বাংলাদেশে ফতোয়ার প্রয়োগ এবং আইনগত বৈধতা এবং
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ফতোয়ার অবস্থান।

আদালত উক্ত রায়ে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগ জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করে। সংবিধানের এই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগ উভয়ই জনগণের অধিকার রক্ষার স্মারক এবং জনবান্ধব।

সংবিধানের ১০২ নম্বর অনুচ্ছেদ হাইকোর্ট ডিভিশনকে রিট পিটিশনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ এখতিয়ার দিয়েছে। সেই জন্য শাহিদা ব্যক্তিগতভাবে আদালতের দ্বারস্থ না হলেও হাইকোর্ট ডিভিশন ‘নওগাঁর গ্রামে আজ ফতোয়বাজদের সালিশে ভাগ্য নির্ধারণ হবে গৃহবধূ শাহিদার’শিরোনামের একটি খবর আমলে নিয়ে এই বিশেষ নির্দেশনা প্রদানের বিশেষ এখতিয়ার রাখে।

রায়ে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশের সংবিধান বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রদান করে। কিন্তু এই বাকস্বাধীনতা কারো বিরুদ্ধে এমনভাবে প্রয়োগ করা যাবে না, যা কিনা  কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত অন্যান্য আইন দ্বারা স্বীকৃত কোনো অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। রায় প্রদানকালে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন যে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর ধারা ৭ অনুযায়ী আলোচ্য ফতোয়াটি অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ এবং ৫০৯ এর অধীনে দণ্ডনীয় অপরাধ।

উল্লেখ্য যে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ ধারা ৭-এ তালাক নিয়ে বলা আছে। এতে বলা হয়েছে যে,
(১) কোনো ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে-কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।
(২) যে ব্যক্তি উপধারা (১)-এ উল্লেখিত ব্যবস্থাবলি লঙ্ঘন করবে, তাকে এক বছর পর্যন্ত বিনা শ্রম কারাদ- অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে।
(৩) নিম্নের (৫) উপধারার ব্যবস্থাবলির মাধ্যমে ব্যতীত প্রকাশ্য অথবা অন্যভাবে প্রদত্ত কোনো তালাক পূর্বেই বাতিল না হলে (১) উপধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানের নিকট নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ হবে না।
(৪) উপধারা (১) অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশ পরিষদ গঠন করবেন এবং অত্র সালিশ পরিষদ এই জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলন) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থায়ই অবলম্বন করবেন।
(৫) তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গর্ভবতী বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে উপরের (২) উপধারায় উল্লেখিত সময় অথবা গর্ভাবস্থা এই দুই এর মধ্যে দীর্ঘতরটি অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না।
(৬) অত্র ধারা অনুযায়ী কার্যকরী তালাক দ্বারা যার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছে সেই স্ত্রী এই জাতীয় তালাক তৃতীয়বার এইভাবে কার্যকরী না হলে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারিবে।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ধারা ৭-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন শাহিদার ফতোয়ার ঘটনাটি। কারণ এখানে বিবাহ-বিচ্ছেদের যে প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে, সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। বরং শামসুলের সাথে শাহিদার হিল্লা বিয়ে শাহিদার মৌলিক মানবাধিকারগুলোর লঙ্ঘন এবং তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের/সহিংসতার শামিল, যা এ দেশে প্রচলিত আইনে দ-নীয় অপরাধ।

ফতোয়াসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের অন্যান্য নির্দেশনা
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-সহ আরো পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন ২০০৯ সালে রিট দায়ের করলে গত ৮ জুলাই ২০১০ তারিখে মাননীয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং মাননীয় বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ফতোয়ার নামে শাস্তি প্রদানকে নিম্নলিখিত আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে মর্মে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন:

শাস্তির ধরন    প্রচলিত আইনে অপরাধ
দোররা বা বেত্রাঘাতের মাধ্যমে আঘাত    দণ্ডবিধি ৩২৩-৩২৬ ধারা
হিল্লা বিয়ে প্রদান    দণ্ডবিধি ৫০৮ ধারা
অন্যায়ভাবে আটক/চলাফেরায় বাধা প্রদান/একঘরে করা    দণ্ডবিধি ৩৪১-৩৪২ ধারা
চুল কেটে দেয়া/জুতার মালা পরানো    দণ্ডবিধি ৩৫৪ ধারা
তওবা পড়ানো/গ্রামছাড়া করা    দণ্ডবিধি ৫০৮ ধারা
মৃতদেহ সৎকারে বাধা প্রদান    দণ্ডবিধি ২৯৫ ধারা
মৌখিক তালাক    মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ৭(২) ধারা।


এ ছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর বিধান অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং নানাবিধ অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

এই বিধানের অংশ হিসেবে ফতোয়ার নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদানসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বলে উক্ত মামলার রায়ে বলা হয়। এ মামলার রায়ে নিম্নলিখিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়
১.    বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রয়োগকারী সকল ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ এবং এই শাস্তি প্রদানের সময় এতে সহায়তাকারী/সহায়তাকারীগণ দ-বিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় বা অন্যান্য আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত হবে।

২.    দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাসমূহ তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকায় ফতোয়া কার্যকরী করার নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদানের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

৩.    সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেশের আইন প্রণয়নকারী সংস্থাসমূহ, সকল ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাকে বিচারবহির্ভূত শাস্তি আরোপ করা যে সংবিধানবহির্ভূত এবং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সে বিষয়ে অভিহিত করবে। এবং সে ব্যাপারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষত মাদ্রাসা পর্যায়ের সিলেবাসে সংবিধানের প্রাধান্য, আইনের শাসন এবং শরিয়া আইন বা ফতোয়া কার্যকরী করার নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি আরোপকে নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বিভিন্ন প্রকার প্রবন্ধ ও শিক্ষামূলক উপকরণ সন্নিবেশিত করবে।

এ ছাড়া, ২০১২ সালে মাননীয় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং মাননীয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল (সুয়োমোটো রুল নং-২০/২০১২) জারি করেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই মামলায় ইন্টারভেনর হয়।

এতে এলজিআরডি সচিব, তথ্যসচিব, পুলিশের আইজিকে তাদের আওতাধীন সকল অফিস, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জ্ঞাতার্থে ‘ফতোয়া ও সালিশের নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া, কাউকে কোনোরূপ শাস্তি প্রদান করা ও কারো কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ এবং যারা এই অপরাধ করবে অথবা কাউকে এই অপরাধ করতে সাহায্য বা প্ররোচিত করবে, তাদেরও একইভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে’এই মর্মে পরিপত্র জারি করতে আদেশ প্রদান করেন।

এ ছাড়া পুলিশের আইজি যেন থানার সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সালিশ ও ফতোয়াসংক্রান্ত আমলযোগ্য অপরাধের তথ্য পাওয়ামাত্র অভিযোগকারীর অপেক্ষা না করে এজাহার দায়ের করার নির্দেশ প্রদান করেনÑ এ মর্মে রুল জারি করা হয় এবং তাদের এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।

উচ্চ আদালতের এই মাইলফলক রায়ের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, এটি ফতোয়াকে সরাসরি নিষিদ্ধ করেনি বরং ফতোয়ার অপব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। অর্থাৎ শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের যখন সরাসরি উত্তর-মীমাংসা পাওয়া যায় না শুধু তখন ফতোয়া বা সেই সম্পর্কে মতামত দেওয়া যাবে।

সেই সঙ্গে ফতোয়ার নামে কোনো ব্যক্তিকে শাসন-শোষণ বা শাস্তি দেওয়া তথা ফতোয়ার অপব্যবহার করে কাউকে নির্যাতন করাকে পুরোপরিভাবে নিষিদ্ধ করেছেন আদালত। আশা করা হচ্ছে, এই পূর্ণাঙ্গ রায় আইনের অস্পষ্টতা দূর করে ফতোয়ার নামে নির্যাতন বন্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক-আইনজীবী

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।