ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে খুঁজবো’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৬
‘বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে খুঁজবো’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘মা-বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। মারা গেলে খবর পেতাম। এখন বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে খুঁজে বের করবো’।

ঢাকা: ‘মা-বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। মারা গেলে খবর পেতাম।

এখন বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে খুঁজে বের করবো’।

 
‘বিনা বিচারে‘ ১৭ বছর ধরে কারাবন্দি থাকা শিপনকে মঙ্গলবার (০৮ নভেম্বর) হাইকোর্টে হাজিরের পর আদালতের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
 
আদালত শিপনের কাছে জানতে চান, ‘জামিন দিলে কোথায় যাবেন?’ এর জবাবে শিপন বলেন, ‘মা-বাবার কাছে’।
 
‘বাবা-মা বা ভাই-বোন কেউ আছে কি-না? কারাগারে আপনার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতেন কি-না? তারা কি করতেন?’- আদালতের এমন প্রশ্নের জবাবে শিপন বলেন, ‘বাবা-মা এবং বোন আছেন। তবে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন না। তারা একটি অ্যালুমনিয়াম কারখানায় চাকরি করতেন। মা-বাবা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। মারা গেলে খবর পেতাম’।
 
১৯৯৪ সালে রাজধানীর সূত্রাপুরে দুই মহল্লার মধ্যে মারামারিতে মাহতাব নামের একজন খুন হন। এ ঘটনায় মো. জাবেদ বাদী হয়ে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন। মামলার দুই নম্বর আসামি মো. শিপন। এফআইআরে তার বাবার নাম ছিলো অজ্ঞাত। পরে  চার্জশিটে তার বাবার নাম মো. রফিক দেওয়া হয়। ঠিকানা ৫৯, গোয়ালঘটা লেন, সূত্রাপুর বলে উল্লেখ করা হয়।
 
দীর্ঘ সময় ধরে মাহতাব হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি না হওয়া এবং ১৭ বছর ধরে আসামির কারাগারে থাকা নিয়ে গত ২৬ অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সংবাদ প্রচার করে।

ওই প্রতিবেদনের অনুলিখন ও সিডি গত ৩০ অক্টোবর আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে। এরপর আদালত কারাগারে থাকা আসামি শিপনকে ০৮ নভেম্বর হাইকোর্টে হাজির করতে কাশিমপুর কারাগার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। অন্তর্বর্তীকালীন এ আদেশের পাশাপাশি ওই আসামিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।

আদেশ অনুসারে হাইকোর্টে হাজিরের পর মঙ্গলবার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত শিপনকে জামিন দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। দুই মাসের মধ্যে তার মামলার নিষ্পত্তিরও আদেশ দিয়েছেন আদালত।

পরে কুমার দেবুল দে বলেন, আদালত আদেশে বলেছেন, ৬০ দিনের মধ্যে এ মামলার বিচার শেষ করতে হবে। সেই পর্যন্ত শিপন জামিনে থাকবেন। যদি বিচার শেষ করতে না পারেন, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
 
এছাড়াও জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর শিপনের কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে জেলা ম্যজিস্ট্রেটের কাছে পুর্নবাসনের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে।      
 
মঙ্গলবার হাজিরের পর আদালতের প্রশ্নের জবাবে শিপন বলেন, ঘটনার (হত্যা) পর বাদীপক্ষ তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তার হাত কেটে দিয়েছেন। এ সময় আদালত মো. শিপনের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে চান। মো. শিপন আদালতকে জানান, ঘটনার পর বাদী তাকে বাড়ি থেকে ডেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যান। এরপর তার হাতের কব্জি (বাম হাত) কেটে দেন। এ সময় তার বাম হাত উ‍ঁচিয়ে আদালতকে দেখান।
 
এরপর আদালত বলেন, ‘সংবিধানের ২৬ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এ ঘটনা রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের জন্য শুধুই লজ্জাজনক নয়, সংবিধানেরও লঙ্ঘন। এর দায় রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের’।

আদালত বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিও (পিপি) দায় এড়াতে পারেন না। তেমনি বিচারকও ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না। একটি সভ্য দেশে এভাবে চলতে পারে না’।

আদালত বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা ও পিপিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য আইন করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা ভালো লক্ষণ নয়। তাহলে গরিব মানুষেরা কি বিচার পাবেন না?’
 
আদালত বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় ১৯৯৪ সালের ২৫ অক্টোবর সূত্রাপুর থানায় মামলা হয়। পরের বছর ১০ মে ৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০০ সালের ৭ নভেম্বর এ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের বছর ২০০১ সালের ২২ নভেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য দায়রা আদালতে যায়। আদালত ২০০২ সালের ২৪ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাদী সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ গত ৫/৬ বছর ধরে কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য-জেরা হয়নি’।

আদালত বলেন, ‘মামলার নথি থেকে দেখা যায়, মামলার প্রধান আসামি আমির হোসেন বাবুর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য পিপি ২০১০ সালের ১৪ জুন আদালতে আবেদন করেন। যদিও আদালত কোনো আদেশ না দিয়ে আবেদনটি নথিতে রেখেছেন। এ অবস্থায় বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে’।

‘ নথি থেকে দেখা যায়, পিপি বার বার সময় নিয়েছেন। এতে বিচার বিলম্বিত হয়েছে’।

আদালত এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম জহিরুল হকের কাছে জানতে চান, ‘এ ব্যর্থতার দায় কার?’

জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম জহিরুল হক বলেন, ‘এটা দায়িত্বহীনতা’।
 
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে আদালত বলেন, ‘এ মামলার পিপি মামলা নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ নেবেন। যদি নতুন করে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে নথিতে যা আছে, তার ভিত্তিতেই আদালত মামলার নিষ্পত্তি করবেন’।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৬
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।