বুধবার (০১ নভেম্বর) সকালে ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে।
গত ০৬ আগস্ট দেওয়া রায়ে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ দু’জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।
ওই রায়ে বিশ্বজিৎ হত্যার পর তার মরদেহের সুরতহালকারী সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হক ও ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মাকসুদুর রহমান বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
তদন্ত করে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) এসআই জাহিদের বিরুদ্ধে এবং স্বাস্থ্যসচিব ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) ডা. মাকসুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- সে বিষয়ে সময়ে সময়ে প্রতিবেদন দিতে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদকে দায়িত্ব দেন হাইকোর্ট।
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পেয়েছি। তদন্তে গাফিলতি ছিলো কি-না- সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সময়ে সময়ে আদালতকে অবহিত করে প্রতিবেদন দেবো’।
বিচারিক আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ পাওয়া ৮ জনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। তাদের মধ্যে রাজন পলাতক। অন্য ছয়জনের মধ্যে মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক এমদাদ, জিএম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মোহাম্মদ নূরে আলম লিমনের সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। লিমন পলাতক থাকলেও অন্য তিনজন কারাগারে আছেন।
খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম সাইফুল ও কাইয়ূম মিয়া টিপু বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। আর গোলাম মোস্তফা মোস্তফা ও এ এইচ এম কিবরিয়াকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যে ১১ আসামির বিষয়ে হাইকোর্ট কোনো মন্তব্য করেননি, তারা হলেন- খন্দকার মো. ইউনুস আলী ইউনুস, তারিক বিন জহুর তমাল, মো. আলাউদ্দিন, মো. ওবায়দুল কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন ইমরান, আজিজুর রহমান আজিজ, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মোশাররফ।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, পলাতক আসামিরা গ্রেফতার হলে বা আত্মসমর্পণ করলে তাদের বিষয়ে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এ মামলায় আটটি আপিল ও সাতটি জেল আপিল করেন আসামিরা। এসব আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি একসঙ্গে নিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, ‘এটি কোনো পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের কারণেই হত্যার শিকার হন বিশ্বজিৎ’।
‘বিশ্বজিৎ কোনো রাজনৈতিক দল করতেন না। তিনি ছিলেন নিরস্ত্র ও নিরীহ। এ হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত না হলেও হামলাকারীদের সম্মিলিত উন্মত্ত আক্রমণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
হাইকোর্ট বলেন, ‘মিটফোর্ড হাসপাতালে নিহতের বড় ভাই উত্তম কুমার দাস বিশ্বজিতের শরীরে দু’টি আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। সাক্ষ্য ও ভিডিওচিত্রেও বিশ্বজিতের শরীরে একাধিক আঘাতের উল্লেখ রয়েছে। অথচ মামলার সুরতহাল, ময়না তদন্তের রিপোর্টে একটি মাত্র আঘাতের কথা এসেছে। তবে প্রতিবেদন দু’টিতে আঘাতের স্থানের অমিল রয়েছে’।
এ ধরনের রিপোর্ট ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্তরায় মন্তব্য করে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘একটি অস্বচ্ছ তদন্ত সামাজিকভাবে বিপর্যস্ততা সৃষ্টি করতে পারে এবং সমাজে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। ফলে ন্যয়বিচারের স্বার্থেই এ দু’টি (সুরতহাল ও ময়না তদন্ত) বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন’।
‘যারা বা যিনি সুরতহাল ও ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তারা তাদের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা বা গাফিলতি করেছেন কি-না- সেটিও অনুসন্ধানের দাবি রাখে’।
রায়ে আরও বলা হয়, ‘কিছু রাজনৈতিক নেতা হীনস্বার্থে ছাত্র রাজনীতির নেতাকর্মীদের অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন, এতে তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি আরো সমৃদ্ধ হবে’।
হাইকোর্ট বলেন, ‘এমন একটি সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে যে, মিছিলে বা কর্মসূচিতে সমাগম বাড়াতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এখন বাধ্য করা হয়। অনেক সময় আবাসিক শিক্ষার্থীরা সিট ধরে রাখতে মিছিলে বা কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হন’।
‘যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলীয় বা সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করেন, তবে তাদের নির্যাতনের শিকারও হতে হয়’।
২০১২ সালের ০৯ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর এ হত্যা মামলার রায়ে ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম নিজামুল হক।
বিচারিক আদালতের ওই রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছে। এরপর ১৫টি আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্তরা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে হাইকোর্টে আসে।
পেপারবুক উপস্থাপনের পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
গত ১৬ মে থেকে মোট ১৫ দিনের মতো এ মামলায় আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয় হাইকোর্টে। ১৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ ও ১৭ জুলাই আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আসামিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহান, লুতফর রহমান মন্ডল, সৈয়দ আলী মোকাররম, সৈয়দ শাহ আলম, মো. আব্দুস সালাম, মো. ইসা, সৈয়দ মাহমুদুল আহসান।
পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মোমতাজ বেগম।
গত ১৭ জুলাই শুনানি শেষে রায়ের দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৭
ইএস/ এএসআর