সোমবার (১১ ডিসেম্বর) পটুয়াখালীর বাউফলের নিরাময় ক্লিনিকের মালিক, ভুয়া চিকিৎসক ও মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকোর্টে হাজিরের পর বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের আদালত এমন মন্তব্য করেন।
একটি জাতীয় দৈনিকে গত ২২ জুলাই ‘সাড়ে তিন মাস পর পেট থেকে বের হল গজ!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এ ঘটনায় ২৩ জুলাই পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ও পটুয়াখালীর বাউফলের নিরাময় ক্লিনিকের মালিককে তলব করে রুল জারি করেন একই হাইকোর্ট বেঞ্চ। ১ আগস্ট হাইকোর্টে হাজির হয়ে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় তাদের।
রুলে ওই ঘটনায় কেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হবে না, তা জানতে চান হাইকোর্ট। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ ৯ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
পরে পটুয়াখালীর সিভিল সার্জনের কাছে ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদন চান হাইকোর্ট। সে প্রতিবেদনেই চিকিৎসক রাজন দাসের লাইসেন্সটি ভুয়া বলে উল্লেখ করা হয়।
এরপর ৬ নভেম্বর চিকিৎসকরূপী এই প্রতারকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন হাইকোর্ট। কিন্তু তার আইনজীবী কয়েক দফা সময় নিয়েও তাকে হাজির করতে পারেননি। এমনকি পুলিশও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি বলে আদালতকে অবহিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। অবশেষে সোমবার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন অর্জুন চক্রর্বতী।
সোমবার শুনানির শুরুতেই আদালত বলেন, ‘সেই লোক (চিকিৎসকরূপী প্রতারক রাজন দাস) কোথায়?’
আইনজীবী গোলাম নবী তখন তার মক্কেল রাজনকে দেখিয়ে বলেন, ‘হি ইজ দ্য পারসন। ’
আদালত বলেন, ‘আমরা তো তাকে অ্যারেস্ট করে আনতে বলেছি। এএজি (সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) সাহেব কই?’
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শশাঙ্ক শেখর সরকার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘অন্য কোর্টে গেছেন। আমরা চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ পুলিশ চেষ্টা করেছে। তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি, ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এখন সে নিজেই আদালতে হাজির। তার আসল নাম হচ্ছে অর্জুন চক্রবর্তী। বাড়ি চাঁদুপরের মতলবে। ’
এ সময় আদালত রাজন দাসকে জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কে? আপনার নাম কি?’
জবাবে কথিত রাজন দাস বলেন, ‘অর্জুন চক্রবর্তী’।
আদালত বলেন, ‘তাহলে রাজন কে?’
তখন তিনি (অর্জুন) চুপ করে থাকেন। এরপর আদালত রাজন নামধারী অর্জুনকে জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কি ডাক্তার?’
জবাবে রাজন নামধারী অর্জুন বলেন, ‘না। অল্টারনেটিভ মেডিসিন’। এ সময় আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন চিকিৎসকরূপী প্রতারক রাজন দাস ওরফে অর্জুনের পক্ষে দাঁড়াতে চাইলে আদালত বলেন, ‘হি ইজ আ ফেইক ডক্টর। মি. ইসলাম ছবিগুলো দেখুন। (ক্ষতিগ্রস্ত নারীর অস্ত্রোপচারের বীভৎস ছবি)। ’
তখন এ আইনজীবী সরে দাঁড়ালে আদালত কথিত রাজনকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘আপনি ডাক্তার না হয়ে মহিলার পেট কেটেছেন। আমাদের মানুষদের কি কোনো দাম নেই? কসাইরাও তো এরকম করে না। ওদেরও একটি নিয়ম আছে। ভুয়া ডাক্তার আপনি। অ্যারেস্ট হিম, এক্ষুনি তাকে অ্যারেস্ট করেন। পুলিশ কই? সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে দিয়ে দেন। শাহবাগ থানায় তুলে দেওয়ার জন্য। ’
এ সময় পটুয়াখালী সিভিল সার্জনের আইনজীবী শামসুদ্দিন বাবুল বলেন, ‘সে তো রাজন না। রাজনের ছবির জায়গায় ছবি লাগিয়ে রাজন দাস হয়েছে। ’
তখন আদালত বলেন, ‘মালিক (ক্লিনিকের মালিক) কোথায়?’
এ সময় মালিক ডায়েসের কাছে এগিয়ে আসেন। আদালত তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার এটা কি (নিরাময় ক্লিনিক) ক্লিনিক, নাকি কসাইখানা?’
জবাবে মালিক বলেন, ‘ক্লিনিক। ’
এরপর রাজন দাসকে দেখিয়ে আদালত বলেন, ‘এর সার্টিফিকেট আছে? ও কি ডাক্তার? অপারেশন কি উনি করেছেন? আপনারা কি জানেন?’
জবাবে ক্লিনিকের মালিক বলেন, ‘সার্টিফিকেটের ফটোকপি দিয়েছে। ’
আদালত বলেন, ‘শুধু পেট কেটে সেলাই করলে ডাক্তার হয়ে যায়! ওটা কি ক্লিনিক, নাকি কসাইখানা? এতোবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল ভিকটিমের কোনো খোঁজ-খবর নিয়েছেন?’
জবাবে মালিক বলেন, ‘আমরা রোগীর চিকিৎসার জন্য এক লাখ ১৩ হাজার টাকা দিয়েছি। ’
আদালত বলেন, ‘এতেই সব হয়ে গেছে? এক লাখ ১৩ হাজার টাকাই কি যথেষ্ট?’
মালিক বলেন, ‘না, লাগলে আরও দেব। ’
এরপর ভুয়া চিকিৎসক রাজন দাসের সহকারী মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট তোফায়েল সিকদার ওরফে মিশু সিকদারকে সামনে ডেকে আদালত বলেন, ‘আপনি কি তার সহকারী?
জবাবে মিশু বলেন, ‘হ্যাঁ। আমি মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট। ’
আদালত বলেন, ‘তার সঙ্গী ছিলেন আপনি। আপনি জানেন না যে সে ভুয়া ডাক্তার?’
এ সময় মিশু সিকদার বলেন, ‘না। আমাকে যে ডাক্তার দেবে আমি তার সঙ্গেই কাজ করবো। আমি কিভাবে বুঝবো! এটা তো প্রতিষ্ঠান দেয়। ’
এরপর আদালত ভিকটিমের অস্ত্রোপচারের সময়ের ছবি দেখে বিস্ময়ে বলেন, ‘আমরা কোন যুগে বাস করছি! এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! এটা ভয়ানক! মার্ডারের মত একই কাজ!’
এ সময় ভুয়া চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের শিকার মাকসুদা বেগমের আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক বলেন, তাকে এ ক্ষত অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হবে। ’
আদালত বলেন, ‘উনার (ভিকটিমের) লাইফ তো শেষ। হোমরা-চোমড়ারা সিজার করে। ’
এ পর্যায়ে শামসুদ্দিন বাবুল বলেন, ‘ও তো (রাজন দাস) মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। রাজন দাসের নামে তার আইনজীবী বিভিন্ন সময় আবেদন করেছিল। এখন এ মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো রুল জারি করা উচিত। ’
তখন আদালত বলেন, ‘আগে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হোক। তারপর দেখা যাবে। ’
পরে শামসুদ্দিন বাবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘কথিত রাজন দাসের বিরুদ্ধে বাউফল থানায় একটি মামলা আছে। তাকে সে মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে শাহবাগ থানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছে। এছাড়া এ ঘটনার সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে বাউফল থানার ওসিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ’
ইমরান এ সিদ্দিক বলেন, ‘ভুয়া চিকিৎসক, ক্লিনিকের মালিক, নার্স ও মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্টের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেওয়ার পর আমরা ডেপুটি রেজিস্ট্রারের কক্ষে যাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায় রাজনের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় বাউফল থানায় একটি মামলা আছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু এক অপরাধে দুই মামলা হয় না, তাই দুপুর একটার দিকে বিষয়টি কোর্টের নজরে আনি। পরে কোর্ট রাজনকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করতে নির্দেশ দেন। অপর তিনজনের বিষয়ে আদালত কিছু বলেননি। তবে ১৩ ডিসেম্বর এ বিষয়ে আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৭
ইএস/জেএম