প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এমন মন্তব্য করেন।
রোববার (০৪ ফেব্রুয়ারি) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে অভিনন্দন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
মাহবুবে আলম বলেন, ‘সংবিধানের বিধানমতে আপনি ২০২১ সনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকবেন। এ সময়টা একটি দীর্ঘ সময়, প্রায় চার বছর সময়। বর্তমানে আমাদের বিচার বিভাগের যে অবস্থা, আপনার এই সময়কালে তাতে আপনি আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন, যদি এ বিষয়ে আপনি দৃঢ়ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। ’
বিচার বিভাগ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বেশ কয়েকবছর যাবত আমাদের বিচার বিভাগের অবক্ষয় ঘটেছে। সাধারণ জনগণের কাছে এ আদালতের যে ভাবমূর্তি ছিল তাতে পরিবর্তন ঘটেছে। ইতোপূর্বে একজন প্রধান বিচারপতিকে এই আদালতে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় আমি এ অবক্ষয়ের কিছু নমুনা তুলে ধরেছিলাম এবং আমার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তদন্তের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তদন্ত অনেকটা অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু যখন পরবর্তী প্রধান বিচারপতি আসলেন, উনার দফতর থেকে সেই ফাইলটি নিখোঁজ হয়ে গেল। ’
মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন বেঞ্চের সম্বন্ধে যেসব আলোচনা হয় তা এখানে প্রকাশ করার মতো নয়। শুধু ভাবি ১৯৭৫ সনে যখন এই আদালতে ঢুকেছিলাম তখন একজন বেঞ্চ অফিসার সম্বন্ধেও কোনোরূপ বিরূপ মন্তব্য শুনিনি। কিন্তু জেনারেল এরশাদের আদালত বিকেন্দ্রীকরণের নামে যখন হাইকোর্ট-এর বিভিন্ন বেঞ্চ ঢাকার বাইরে গেল, আবার অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ের পর যখন ফিরে আসলো, তখন আর সেই আগের অবস্থা রইলো না। আদালত ফিরলেও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চোরাবালিতে আটকা পড়লো এ প্রতিষ্ঠান। ’
‘হয়তো দেখা যায়, চার বছর আগে দায়ের করা মামলা লিস্টে বহাল তবিয়তে আছে, অথচ দু’মাস আগে দায়ের করা মামলা চূড়ান্ত শুনানি হয়ে যাচ্ছে। আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারী মামলা নিচের থেকে উঠানোর কাজ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। কিছু মামলা শুনানি করা যাচ্ছে না। আবার কিছু মামলা শুনানি হয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে। ’
‘আমরা যখন এই আদালতে ঢুকলাম তখন দেখেছি একটি মামলা শুনানি হয়েছে এবং তার রায় দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। কালে-ভদ্রে দু’একটি মামলা রায়ের জন্য সিএভি করে রাখা হতো এবং আগের মামলার রায় শেষ হওয়ার পরে পরবর্তী মামলাটি ধরা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো আদালতে বিনা নোটিশে মামলা আংশিক শ্রুত হচ্ছে। অনেক মামলা শুনানির পরে রায় দেওয়া হচ্ছে না দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আবার দেখাযায় মামলার রায় হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হচ্ছে না মাসের পর মাস। ’
আদালতের সময় নিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ আদালতে যোগদানের পর দেখেছি সকাল সাড়ে ১০টায় ঠিক কাঁটায় কাঁটায় অনেক বিচারপতি এজলাসে বসতেন এবং কোর্টে আসীন হওয়া ও কোর্ট থেকে নেমে পড়ার ব্যাপারে কজ লিস্টে যে সময় দেওয়া আছে তার কোনো ব্যত্যয় হতো না। কিন্তু এখন কজ লিস্টের যে সময় ধার্য করে দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে বিচারকদের আদালতে ওঠা বা নামার কোনই সংগতি নেই। এ অবস্থা চললে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ’
‘সবচেয়ে ভয়াবহ যে বিষয়টি, তা হলো, বিশেষ বিশেষ কোর্ট, বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে এবং অনেক সময় অনেক সিনিয়র অ্যাডভোকেটের কাছ থেকে ব্রিফ নিয়ে তাদের নিয়োগ দান করা হচ্ছে। বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিগণ অনেকে জেনে গেছেন, কোন কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলা জেতা যাবে। এটা তো ন্যায় বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে অনেকেই ছুটছেন বিচারপতিদের সন্তান, স্ত্রী যারা আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত আছেন তাদের দিকে। তাদের চিন্তা, এদের নিয়ে গেলে হয়তো মামলায় জেতা যাবে। বিচারপতিদের আত্মীয় বা সন্তানরা আগেও এ পেশায় ছিলেন কিন্তু কখনও এরূপঅবস্থার সৃষ্টি হয়নি, এখন কেন বিচার প্রার্থীদের আচরণ এরূপ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। ’
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তিনি বলেন, আপনার স্ত্রী, যিনি আমাদের দেশের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ও পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র সচিব তার কন্যা এবং তিনিও এ কোর্টের একজন আইনজীবী। কিন্তু আপনি আপনার ভাবমূর্তিতে কোনরূপ দাগ পড়ুক তা চিন্তা করে তাকে আদালতে আইন পেশা করতে দেননি এবং তিনিও আপনার ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রাখার জন্য নিজের পেশাগত জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্য তার প্রতিও আমি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
‘ইতোমধ্যে আদালতের রায় নিয়ে জাল জালিয়াতি শুরু হয়ে গেছে। আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়নি অথচ জামিনের কাগজ তৈরি করে আসামিরা জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। কিভাবে ইনফরমেশন টেকনোলজিকে আদালতের কাজে আরও ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনি ব্যবস্থা নিবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। ’
তিনি বলেন, ফৌজদারি মামলার জামিনের শুনানির ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পরেছে। নিয়ম করা উচিৎ, যে আদালতে জামিনের জন্য প্রার্থনা করা হবে, সে আদালতে ডিউটিরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের কাছে কপি প্রদান করা, যাতে তারা মামলাটির ব্যাপারে আদালতকে সাহায্য করতে পারেন। এখন যে বিধান আছে, তা হচ্ছে-অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কপি সার্ভ করা, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিধান পরিবর্তন হওয়া দরকার। ’
‘আমি ঢালাওভাবে হাইকোর্টের সমস্ত বেঞ্চের জন্য একথা বলছি না। অনেক বিচারকই বিচারকার্য হাতের মুঠোয় রেখেছেন এবং আদালতের কর্মকর্তাগণ তাদের কথা মতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সঠিকভাবে ও আইনজীবীদের প্রত্যাশা মতো তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কতিপয় বিচারপতির আদালত চালানোর অব্যবস্থাপনা দ্বারা সমস্ত বিচারালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তার কারণ, সুগন্ধের পরিধি হয় সীমিত অথচ দুর্গন্ধের পরিধি হয় বিস্তৃত। ’
মাহবুবে আলম বলেন, ইদানীং ষোড়শ সংশোধনী মামলায় সরকার হেরে গিয়েছে সত্য, আমার বিবেচনায় সরকার হেরেছে, কিন্তু ইতিহাস জিতেছে। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তৎকালীন সরকার যেহেতু চায়নি বিচার হউক, সেজন্য বিচারই শুরু হয়নি। যখন বিচার শুরু হলো, এ আদালতেরই অনেক বেঞ্চ মামলা শুনতে চায়নি এবং সে সময়ে কোনো রায়ে বঙ্গবন্ধুর নামও উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রত্যেক বিচারক বঙ্গবন্ধুকে তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে উল্লেখ করেছেন ও জাতির পিতা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
‘১৯৬৯ সনের গণ-আন্দোলনের সময়ে জনতা বঙ্গবন্ধুকে যে নামে ভূষিত করেছিল, আদালতের রায়ে সে উপাধি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে,আমরা ধরে নিতে পারি, ভবিষ্যতের বিচারপতিগণও বঙ্গবন্ধুকে তার এ নামেই উল্লেখ করবেন এবং এই সর্বোচ্চ আদালত কোনোভাবেই ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে না,’ যোগ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪,২০১৮
ইএস/এমএ