শিরোনামহীন রয়ে যায় আরো কতো কতো হত্যা, খুন, নির্যাতনের ঘটনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এরকম অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনা তথা অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাত।
এসব নানামুখি হত্যা, সংঘর্ষ, অপরাধের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। আততায়ীদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছেন শিক্ষক, মুয়াজ্জিন, পাদ্রী, পুরোহিত। আতঙ্কে থাকেন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা। বাদ যায়নি সাবেক কারারক্ষী, পেশাজীবী, নারী-শিশু, বৃদ্ধ কেউ।
সামাজিক অপরাধের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় নারী ও শিশুরা। রাজনৈতিক অপরাধ বা সহিংসতার শিকার পুরুষরাই বেশি।
কিন্তু কেন এ নির্মমতা, নৃশংসতা, অপরাধ ও পাশবিকতা? কৈশোরে এরশাদ শিকদারের কাহিনী শুনেছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শুনেছি বুড়িগঙ্গা পাড়ের আলম আর নিকট অতীতেসিরিঁয়াল কিলার রসু খাঁসহ আরো কত ভীতিকর নাম।
অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা, প্রযুক্তির প্রসারের ফলেই ঘটছে এসব ঘটনা। কিন্তু কেন বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়? এসব থেকে পরিত্রাণের উপায়ই বা কি? যদ্দিন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের সুরাহা না হবে ততদিন এ সমস্যার মূলোৎপাটনও হবে না। রোগ নির্নয় করতে না পারলে নিরাময়ও সম্ভব হবে না।
নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার দায়্ত্বি রাষ্ট্র তথা সরকারের-এ কথা সত্য। কিন্তু ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে নাগরিক নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো দেশেই এটি সম্ভব হয়নি। কিন্তু যা সম্ভব, তা হচ্ছে নাগরিক অধিকার খর্ব হলে বা নাগরিকের বিরুদ্ধে অপরাধ হলে তার প্রতিকার করা। রাষ্ট্রের নাগরিক কোনো অপরাধের শিকার হলে তার বিচার করাই রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র এ দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র কোনো ‘মগের মুল্লুক’ নয়; বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। শুধু বিচার করলেই হয় না, বিচার হতে হয় দৃশ্যমান (justice should not only be done, but also seen to be done)।
বিচার শুধু বিচার বিভাগই করে না। বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার কায়েমের একটি নিয়ামক প্রতিষ্ঠানমাত্র। এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আরো নানা অনুষঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব।
অনেক অপরাধী দিনের পর দিন থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আইনের ফাঁকফোকর গলে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসছে। এজন্য আমরা বিচার বিভাগকে দায়ী করছি। কিন্তু দিনের পর দিন যদি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হয়, চার্জর্শিট না হয়, বা হলেও দুর্বল চার্জশিট দেয়া হয় তাহলে তো বিচার বিভাগকে দায়ী করে লাভ নেই। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি, বিচারক বদলি, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ইত্যাদি নানান কারণেও বিচার বিলম্বিত হয়, ব্যাহত হয়। এসব বারো রকমের অনুষঙ্গ ও কার্যপদ্ধতির গোলকধাঁধা পেরিয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বৈকি।
কিন্ত তাই বলে তো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে না! অপরাধীর হাত যতো লম্বাই হোক, আইনের হাত তার চেয়েও লম্বা। রাষ্ট্র চাইলে, রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা চাইলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব; সম্ভব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
দ্রুততার সাথে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নজিরও আমাদের কম নয়। আমরা দেখেছি শিশু রাজন হত্যার দ্রুত বিচার হয়েছে। এরকম নজির আরো আছে।
অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি, সেটির পথ চিরতরে রুদ্ধ করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানে দেশে যে সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে তাতে আমাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি, হানাহানি ও উন্মাদনা বাড়ছে। হতাশায় ডুবে যাচ্ছে মানুষ। হতাশা থেকেই ক্ষোভের সৃষ্টি, হতাশার সৃষ্টি। এই হতাশা ও ক্ষোভের কারণে তুচ্ছ ঘটনায় অনেক সময় খুনখারাবি পর্যন্ত হয়ে যায়। গণমাধ্যমে এরকম সংবাদ আমরা দেখি। দুই টাকার জন্য আমরা যাত্রীকে না হয় হেল্পারকেও খুন হতে দেখেছি। ছিনতাইয়ের জন্য ঢাকার রাস্তায় পুড়িয়ে মারা হয়েছে মানুষকে- এ ঘটনা আমাদের অজানা নয়।
ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি ও নৃশংসতার মাত্রা দিনকে দিন যেনো বেড়েই যাচ্ছে। আগে খুন হতো সপ্তাহে একটা, তারপর দিনে একটা। এখন প্রায় প্রতিদিনই এখানে-ওখানে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। সংবাদকর্মীরাও হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই পৃথক সংবাদ না দিয়ে কম্পাইলড করে সংবাদ প্রকাশ করেন তারা: ‘পাঁচ জেলায় ৯ খুন’, ‘দুই জেলায় ৭ ধর্ষণ’, ‘তিন দিনে আহত ৬১’ ইত্যাদি।
তাই অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। সামাজিক ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিরতা দূর করতে হবে। তরুণ ও যুব সমাজ যাতে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে সম্পৃক্ত হতে পারে, সেই সুযোগ ও বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে। একাজে সরকারের সাথে সাথে জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৮
জেএম