ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ হাইকোর্টের

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৯
অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ হাইকোর্টের হাইকোর্ট/ফাইল ফটো

ঢাকা: অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধে একটি নীতিমালা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের সমন্বয়ে এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ কমিটি ছয় মাসের মধ্যে নীতিমালা তৈরি করে আদালতে দাখিল করবেন।

জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে রোববার (৩০ জুন) বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।

আদালতে এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আয়েশা আক্তার।

পরে রাশনা ইমাম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে একটি আদেশ দিয়েছেন। ওনারা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি করবেন এক মাসের মধ্যে। ছয় মাসের মধ্যে একটি নীতিমালা কোর্টে দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। নীতিমালার মূল বিষয়টা হবে যে মেডিক্যালি অপ্রয়োজনীয় যে সিজারিয়ান সেকশনগুলো হচ্ছে, এটার হার যে বাড়ছে সেটা কমানোর।

তিনি আরও বলেন, মেডিক্যালি অপ্রয়োজনীয় যে সি-সেকশনগুলো দেখছি, সে বিষয়ে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি সি-সেকশন কোনো দেশেরই প্রয়োজনীয় হতে পারে না। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এটা প্রায় ৩১ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৮৩ শতাংশ ও সরকারি হাসপাতালে এটার হার ৩৫ শতাংশ। এনজিও হাসপাতালগুলোতে ৩৯ শতাংশ। এই যে একটা অ্যালার্মিং রাইজ, রেটটা যে বাড়ছে এটা থামানোর জন্য এ মামলা।

আদালতে চায়না ও ব্রাজিলের উদাহরণ তুলে ধরেছি উল্লেখ করে রাশনা ইমাম বলেন, চীনে সি সেকশনে হার বিশ্বের মধ্যে খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নতুন রুলস রেগুলেশন প্রণয়নের কারণে এটা কমছে। ব্রাজিলেও একই জিনিস দেখতে পেলাম।

তিনি বলেন, গ্রাম-গঞ্জে যে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো আছে সেগুলো কোনো ধরনের সরকারি মনিটরিং ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সি সেকশন করে যাচ্ছে। এটা থেকে অনেকের অমানবিক মৃত্যুও ঘটেছে।

রুলে সরকারি ও বেসরকারি ক্লিনিকে মেডিক্যালি অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন প্রতিরোধে কার্যকর তদারকি করতে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

চার সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতিকে রুলের জবাব দিতে হবে।  

এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের পক্ষে তাদের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম এ রিট করেন।  

গত ২১ জুন বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ বলছে বাংলাদেশে গত দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ।

বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, এতে বাবা-মায়েদের সন্তান জন্মদানে ব্যাপক খরচের ভার বহন করতে হচ্ছে।


সিজারিয়ানের কয়েকটি ঝুঁকি
সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে রয়েছে নানা রকম ঝুঁকি, বলছে সেভ দ্য চিলড্রেন। সংস্থাটি তার কয়েকটি তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে।

সংস্থাটি বলছে মা ও শিশু উভয়কেই এমন অস্ত্রোপচার ঝুঁকিতে ফেলে।

শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে ইনফেকশন ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অঙ্গহানি, জমাট রক্ত ইত্যাদির কারণে মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে প্রাকৃতিক প্রসবের তুলনায় দীর্ঘ সময় লাগে।

এছাড়া সিজারিয়ানের কারণে প্রাকৃতিক জন্মের লাভজনক দিকগুলোও নষ্ট হতে পারে।

যেমন- শিশু মায়ের প্রসবের পথ দিয়ে যদি স্বাভাবিকভাবে বের হয় তাহলে তার শরীর কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। অস্ত্রোপচারের ফলে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে যেতে পারে না। যার ফলে এই ভালো ব্যাকটেরিয়া সে পায় না।

এছাড়া মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সঙ্গে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার সিজারিয়ান হলে সেটি প্রয়োজনের তুলনায় দেরিতে ঘটে। কারণ মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় দূরে রাখা হয়।

একদম শুরুর দিকে মায়ের বুক দুধের বাড়তি উপকারিতা রয়েছে। তা থেকে সে বঞ্চিত হয়।

প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে
২০১৮ সালে বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানে খরচ করেছেন প্রায় চার কোটি টাকার বেশি। জনপ্রতি গড়ে তা ছিল ৫১ হাজার টাকার বেশি। সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানের হার বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মারাত্মক হারে বেশি।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যত শিশু জন্ম নেয় তার ৮০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।

সংস্থাটি আরও বলছে, ২০১৮ সালে যত সিজারিয়ান হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই চিকিৎসাগতভাবে অপ্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তারপরও এমন সিজারিয়ান হচ্ছে।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, ২০০৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ৪ থেকে ৩১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন এমন অপ্রয়োজনীয়ে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচার ঠেকাতে ডাক্তারদের উপর নজরদারির পরামর্শ দিচ্ছে।

এমন প্রবণতার জন্য সংস্থাটি আংশিকভাবে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবাখাতের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে।

সংস্থাটি বলছে, কিছু অসাধু চিকিৎসক এর জন্য দায়ী, যাদের কাছে সিজারিয়ান একটি লাভজনক ব্যবসা।

বাংলাদেশে সেভ দ্য চিলড্রেনের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং নবজাতক ও মাতৃ-স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ইশতিয়াক মান্নান বলেন, চিকিৎসক ও চিকিৎসা সুবিধা আসলে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে না গিয়ে অস্ত্রোপচার করতে অনুপ্রাণিত করে।

ড. মান্নান আরও বলছেন, অস্ত্রোপচারের এই জনপ্রিয়তা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে দিনকে দিন মায়েরা আরও বেশি এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের দিকে ঝুঁকছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৯
ইএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।