মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) এ মামলায় আপিল বিভাগে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আপিল শুনানি শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা জানান।
নিজ কার্যালয়ে মাহবুবে আলম বলেন, সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার দীর্ঘদিন শুনানির পর আজ শুনানি শেষ হয়েছে।
মাহবুবে আলম বলেন, আমি আজ আদালতে জোরালোভাবে আবেদন জানিয়েছি, যে দু’টি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো হিরামণি সাঁওতালকে ধর্ষণের জন্য পাকিস্তানি আর্মিকে ইশারা দিয়ে ভিতরে দেওয়া এবং পরে তাকে ধর্ষণ করা। এরফলে তার গর্ভে একটি সন্তান জন্ম নিয়েছিল। সেই সন্তানটিকে দেখতে সাঁওতালদের মতো না। এ কারণে অনবরত ধিক্কার পাচ্ছিল। যে কারণে সে কোনো এক সময় আত্মহত্যা করে।
‘আরেকজন ছিল মাজেদা। যাকে আসামি কায়সার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। সেও ধর্ষিত হয়েছিল। তারও একটি মেয়ে সন্তান হয়। সে মেয়েটিও সারাটি জীবন ধিকৃত হয়ে জীবনযাপন করেছে। ’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলায় আমি আবেদন করেছি, একজন মানুষকে হত্যা করলে তখনই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ধর্ষিতা যে তার জন্য প্রতিদিনই মৃত্যু। এটা তার জন্য মৃত্যু, পরিবারের জন্য মৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ মারা গেলে ওই পরিবারের সদস্যরা গর্ব করে বলে তার পরিবারের লোক শহীদ হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সেটি কেউ বলতে পারে না, তার পরিবারের কেউ ধর্ষিত হয়েছে। এই যুক্তি দেখিয়ে আমি বলেছি, এই দু’টি অভিযোগে যাতে মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়।
গত ১০ জুলাই এ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে সর্বোচ্চ সাজাসহ ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
একাত্তরে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ২ নারীকে ধর্ষণ, ৫ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ষড়যন্ত্রের ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ১৪টিই প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনার দায়ে ফাঁসির আদেশ পান কায়সার। সাঁওতাল নারী হীরামণি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ দু’টি প্রমাণিত হয় রায়ে। ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী ও ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্যও দেন কায়সারের বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির সাজা বাতিল ও বেকসুর খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেন (নম্বর: ০৪/২০১৫) কায়সার। ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিলের পক্ষে মোট ৫৬টি যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি।
কায়সারের বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০/৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান।
এমনকি ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফর্মও ছিল।
কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালান।
রায়ের পর্যবেক্ষণে কায়সার বাহিনীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী বা অক্সিলারি ফোর্স না বললেও ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ বাহিনী ও সৈয়দ কায়সার ভিক্টিম ও অপরাধ সংঘটনস্থল এলাকাগুলোর মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবেন।
ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেওয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য এবং সব নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনাদের স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯
ইএস/এএ