ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘আইন প্রণেতা কীভাবে নিজেই আইন হাতে তুলে নেন’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৮ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২১
‘আইন প্রণেতা কীভাবে নিজেই আইন হাতে তুলে নেন’

ঢাকা: ‘সংসদ সদস্যরা হলেন আইন প্রণেতা। আর একজন সাবেক সংসদ সদস্য হয়ে নিজেই কীভাবে আইন হাতে তুলে নেন?’ রাজধানীর পল্লবীর সাহিনুদ্দিন হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে করা রিমান্ড আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এই প্রশ্ন রাখেন।

রাজধানীর পল্লবীতে ৬ বছরের ছেলের সামনে বাবা ব্যবসায়ী সাহিনুদ্দিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার মামলায় শুক্রবার (২১ মে) বিকেলে সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালসহ তিন আসামির চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি রিমান্ডের এই আদেশ দেন।

রিমান্ডে যাওয়া অপর দুই আসামি হলেন—জহিরুল ইসলাম বাবু ওরফে বাইট্টা বাবু এবং নুর মোহাম্মদ হাসান। এছাড়া দিপু নামে আরেক আসামিকে রিমান্ড শেষে এদিন কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সৈয়দ ইফতেখার হোসেন সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালসহ গ্রেফতার তিন আসামির ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, এই তিন আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও লোকজন নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে থাকেন। গ্রেফতার এই তিন আসামি মামলার ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মর্মে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা।

মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ঘটনায় জড়িত অন্যান্য এজাহারনামীয় পলাতক আসামিদের গ্রেফতার ও অজ্ঞাতনামা আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে আসামিদের ১০ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

রাষ্ট্রপক্ষে সিএমএম আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আজাদ রহমান, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন।

শুনানিতে তারা বলেন, এটা একটি ন্যক্কারজনক এবং নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। ঘটনার সময় নিহতের সন্তান তার সঙ্গেই মোটরসাইকেলে ছিলেন। আসামিরা সুকৌশলে ঘটনাস্থলে নিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে নিষ্ঠুরতম উপায়ে সন্তানকে একটি গ্যারেজে আটকে রেখে তাকে হত্যা করে। এ সময় বাবাকে বাঁচাতে সন্তান চিৎকার করতে চাইলেও তাকে চিৎকার করতে দেওয়া হয়নি। বাবার কাছে যেতেও দেওয়া হয়নি। নিহত সাহিনুদ্দিনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেও যেতে দেওয়া হয়নি। মামলাটি স্পর্শকাতর। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পলাতক আসামিদের গ্রেফতার ও হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন: সাবেক এমপি আউয়াল চার দিনের রিমান্ডে

আসামিপক্ষে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন ও সাহিমউদ্দিন রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।

শুনানিতে তারা বলেন, আসামিরা ঘটনাস্থলে ছিলেন না। ঘটনাস্থল তার বাসা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। হেয় প্রতিপন্ন করতে তাদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। সাহিনুদ্দিনের সঙ্গে আউয়াল সাহেবের প্রকল্পের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। এ নিয়ে কোর্টে মামলাও হয়েছে। মামলায় তারা জিততে পারবে না। এ অবস্থায় প্রকল্পের জমি আত্মসাৎ করতে তাকে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, হত্যাকাণ্ডের এ ঘটনার জন্য আমরা দুঃখিত ও মর্মাহত। সাহিনুদ্দিন একজন সন্ত্রাসী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রয়েছে। তারপরও আমরা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিন্দা জানাই। ‘পরামর্শ’ আর ‘প্ররোচনা’ এই দুটি শব্দ দিয়ে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি ও সাবেক এমপি। ঘটনার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে জড়ানো হয়েছে। তিনি একজন বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ। তাই রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করছি। প্রয়োজনে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, কেউ খারাপ হলেই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তাকে মেরে ফেলতে হবে? তিনি একজন সাংসদ ছিলেন। তারাই তো সংসদে আইন পাস করেন। আইন পাস করে নিজেরাই আইন তুলে নেবেন? আর দূরত্ব ৬ কিলোমিটার বা ৬ হাজার কিলোমিটার হোক, তিনি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হত্যায় অংশ নিয়েছেন। সন্তানের সামনে বাবাকে হত্যা করা হলো। বাবা চরম দুশমন হলেও কোনো সন্তান এ মৃত্যু মেনে নিতে পারে না। রিমান্ড আবেদন যৌক্তিক। তদন্তে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে তিনি দোষী না নির্দোষ।

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

বৃহস্পতিবার সকালে ভৈরবের একটি মাজার থেকে সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়ালকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

মামলার বিবরণীতে জানা যায়, গত ১৬ মে পল্লবীতে আধিপত্য বিস্তার ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সাহিনুদ্দিন (৩৩) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত সাহিনুদ্দিনের মাশরাফি নামে ৭ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। ঘটনার সময় সে তার বাবার সঙ্গে ছিল।

বিকেলে মাশরাফি তার বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরছিল। এমন সময় একজন তার বাবাকে ফোন করে ৩১ নম্বর রোডে দেখা করার কথা বলে। সেখানে পৌঁছালে মাশরাফিকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে তার বাবার সঙ্গে বাদানুবাদে জড়ায় ওই ব্যক্তি।

এরপর তার চোখের সামনেই তার বাবাকে লাথি মেরে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেয় ৬-৭ জন। এরপর তারা তাকে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। বাঁচার জন্য নিহত ওই ব্যক্তি পাশের একটি বাড়ির গ্যারেজে আশ্রয় নিলেও সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।

এই ঘটনায় নিহতের মা পল্লবী থানায় ২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য আউয়ালকে।

মামলায় বাদী অভিযোগ করেছেন, পল্লবীর আলীনগর এলাকায় তাদের প্রায় ১০ একর জমি জবরদখলের পাঁয়তারা করছিল আসামিরা। এর জের ধরেই তারা তার ছেলেকে হত্যা করেছে।

এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১৯ মে মো. সুমন ব্যাপারী (৩৩) ও মো. রকি তালুকদারকে গ্রেফতার করা হয়। তারা বৃহস্পতিবার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাংসদ এম এ আউয়ালকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান ও তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। তিনি হাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২১
কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।