ঢাকা: করোনার ছোবলে ২০২১ সালে প্রায় চার মাস আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবুও বছর শেষে বেশকিছু আলোচিত রায় ও ঘটনায় দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল ঢাকার নিম্ন আদালতের দিকে।
সালমান শাহর মৃত্যুর প্রতিবেদন আদালতে গ্রহণ:
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ধুমকেতুর মতো আগমন হয় নায়ক শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের, যিনি সালমানহ শাহ নামেই ভক্তদের কাছে সমধিক পরিচিত। তবে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় নেন তিনি।
ঢালিউডের এই সুপারস্টারের মৃত্যু নিয়ে যে রহস্য তৈরি হয়, তার জট খুলতে লেগে যায় ২৫ বছর। শেষ পর্যন্ত চলতি বছর ৩১ অক্টোবর ঢাকার আদালতে এই মামলা পরিসমাপ্ত হয়। সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছেন- মর্মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া প্রতিবেদন ওইদিন গ্রহণ করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ। সেদিন সালমান শাহর মায়ের পক্ষে আইনজীবীর করা নারাজি ও মা নীলা চৌধুরীর জবানবন্দি গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলাটির পরিসমাপ্তি টানেন আদালত।
সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। তবে, ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি সেটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন জানান। এই মামলায় ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়।
সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন। পরে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক ইমদাদুল হক। ওই প্রতিবেদনেও সালমান শাহের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই মামলার বাদী সালমান শাহের বাবার মৃত্যুর পর তার মা নীলা চৌধুরী অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নারাজির আবেদন দাখিল করেন। নারাজি আবেদনে উল্লেখ করা হয়- আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন সালমান শাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন।
এরপর মামলার তদন্তভার পায় র্যাব। তবে র্যাবকে তদন্ত দেয়ার আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করে। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েশ রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশন মঞ্জুর করে র্যাবকে মামলাটি আর না তদন্ত করার আদেশ দেন। তখন মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন মাজিস্ট্রেট আদালতে ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম। এই প্রতিবেদনেও সালমান শাহ’র মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই উল্লেখ করা হয়। এভাবে দীর্ঘ আড়াই দশকে তিনটি সংস্থার তদন্তের পর সালমান শাহ’র মৃত্যুর বিষয়ে প্রতিবেদন আদালতে গৃহীত হলো।
ঝুলে থাকলো সাগর-রুনি ইস্যু:
দীর্ঘ নয় বছরেও কোনো সুরাহা হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার। একাধিক সংস্থার হাত বদলের পর এখনো এই মামলায় দাখিল হয়নি তদন্ত প্রতিবেদন। তাই ২০২১ সালেও আদালতে একইভাবে ঝুলে থাকলো এই মামলাটি।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন।
প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরে বাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ঘটনার চারদিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব)।
সেই থেকে নয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। সবশেষ গত ২৪ নভেম্বর এই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। তবে সেদিনও প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ায় ৮৩তম বারে এই প্রতিবেদনের সময় পিছিয়ে ২৬ ডিসেম্বর পুনরায় দিন ধার্য করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী।
জমা পড়েনি ফারুকী হত্যার প্রতিবেদনও:
২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজা বাজারের নিজ বাড়িতে খুন হন টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। ওইদিন এশার নামাজের পর অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা বাসায় ঢুকে তার স্ত্রী ও এক ছেলেসহ তিন স্বজনের হাত-পা বেঁধে ফারুকীকে গলাকেটে হত্যা করে।
ওই ঘটনায় পরে তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে। দীর্ঘ সাত বছরেও এই মামলায় সংস্থাটি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। তাই ২০২১ সালেও এই মামলাটি সেই আগের অবস্থাতেই ঝুলে রইল।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
কেআই/এএটি