ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

লাইফস্টাইল

পাত্র-পাত্রী খোঁজার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম, স্বস্তির সঙ্গে আছে হয়রানিও

কবির আবরার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩
পাত্র-পাত্রী খোঁজার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম, স্বস্তির সঙ্গে আছে হয়রানিও প্রতীকী ছবি

ঢাকা: একটা সময় মানুষ বিয়ের জন্য নির্ভর করতো ঘটকদের সন্ধান দেওয়া পাত্র-পাত্রীর ওপর। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও কম-বেশি পরিলক্ষিত হতো।

এখন সময় পাল্টেছে। ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় প্রান্তিক এলাকাও।  

সমাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনও যেন আবশ্যম্ভী হয়ে ওঠছে। তাইতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশে বাড়ছে ‘ভার্চুয়াল ম্যারেজ মিডিয়া’।  

বিশ্লেষণ বলছে, অনেকে নিজেদের মানদণ্ড অনুযায়ী সঙ্গীর খোঁজ পেলেও, মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখেছেন কেউ কেউ। হয়েছেন ‘হ্যারাজমেন্ট’ কিংবা হয়রানি বা প্রতারণার।

 বাংলাদেশে অধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’। এতে সার্চ করে দেখা গেছে, ম্যারেজ মিডিয়া লিখলে শত শত ফেসবুক গ্রুপ পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম প্রফেশনাল ম্যারেজ মিডিয়া বিডি, ম্যারেজ মিডিয়া।  

এ দুটো গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এছাড়া বাকিগ্রুপগুলোতে ৫০০ থেকে শুরু করে প্রায় এক লাখ লোক সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত আছেন। অধিকাংশ গ্রুপের নাম ম্যারেজ মিডিয়া দিয়ে হলেও আঞ্চলিক ও বিশেষ শর্তযুক্ত (ডিভোর্সি, ধার্মিক) গ্রুপও রয়েছে।  

তেমনই একটি হল আল ইয়াকিন ম্যারেজ মিডিয়া ফেসবুক পেজ। এখানে একটি ফরম্যাটে সংশ্লিষ্ট পাত্র কিংবা পাত্রীদের তথ্য দেওয়া থাকে। সেখানে ধর্ম পালনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এছাড়া ‘ডিভোর্সের গল্প কথা’ নামে গ্রুপে ডিভোর্স পাত্র-পাত্রীর তথ্য শেয়ার করা হয়ে যেখান থেকে পুনরায় বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন অনেকে।

 শুধু ফেসবুক নয়, গুগল প্লে-স্টোরে ম্যাট্রিমনি লিখে সার্চ করলেও আসছে অসংখ্য অ্যাপসের। Bangladeshi Matrimony, Bengali Matrimony, dmarriage.com, Muslim Matrimony সহ অনেক অ্যাপসেরই সাজেশন্স আসে।  

প্রথমে ইনস্টল করে তাতে নিবন্ধন করে নিজের যাবতীয় তথ্য দিলে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি (পাত্র কিংবা পাত্রীর) প্রোফাইল উন্মুক্ত হয়। তখন নিজেদের লক্ষ্য মিলে গেলে বিয়ে করতে আগ্রহী হন। এছাড়া ইউটিউবে বিভিন্ন চ্যানেল ভিডিও কনটেন্ট ও লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে পাত্র কিংবা পাত্রীর তথ্য তুলে ধরে। আগ্রহীদের যোগাযোগ করার অনুরোধ করে।

ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এডমিন-মডারেটর কিংবা পক্ষ হয়ে এসব মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী চেয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। যদিও সদস্য হওয়ার আগে গ্রুপের নিয়ম মানার অঙ্গীকার নেওয়া হলেও পরবর্তীতে সেটি অনেকে মানছেন না। কেউ কেউ হয়রানিমূলক কমেন্ট করছেন। অনেকে ইনবক্সে কুরুচিপূর্ণ বার্তা দিচ্ছেন। আবার অনেকে এসব গ্রুপের মা্ধ্যমে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

ফেসবুক থেকে পছন্দের পাত্রী খুঁজে পেয়েছেন চাঁদপুরে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা রাসেল মিয়া।  
বাংলনিউজকে জানান, একদিকে বয়স বাড়ছে আবার চাকরির চাপের কারণে মেয়ে দেখাতে সময় দিতে পারছিলেন না। পরে ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দিয়ে এক মাসের মধ্যে পাত্রী খুঁজে পান। পরে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়।

তবে মুদ্রার উল্টো পিঠ ও দেখতে হয়েছে অনেকেই। বিশেষ করে মেয়েদের পড়তে হয় নানান রকম ঝামেলায়। ‌ খাদিজা সুলতানা (ছদ্মনাম) তেমনি একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী। তিনি তার দ্বিতীয় বিবাহের উদ্দেশ্যে একটি ফেসবুক গ্রুপে বিস্তারিত তথ্য সহকারে পোস্ট করেন। এতে কিছু মানুষ তার ইনবক্সে নানা কুরুচিপূর্ণ ও কটু মন্তব্য ও প্রস্তাব করেন বলে বাংলানিউজকে জানান তিনি।  

কিছু মানুষ আবার খুব আন্তরিকতার সাথে কথা বলে ছবি হাতিয়ে নেয়। ছবি হাতে পাওয়ার পরে তারা আর কথোপকথন চালিয়ে যায় না। এরকম হয়রানির শিকার আরো অনেকেই হয়েছে বলে জানান তিনি।  

তবে আইনের দীর্ঘ মারপ্যাঁচের কারণে ও সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে মোটামুটি সবাই এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।

প্রতারণার শিকার হওয়ার তালিকায় রয়েছে পুরুষরাও। এমনই একজন ভুক্তভোগী রাজধানীর একটি বায়িং হাউস প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন কর্মকর্তা।  

নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাংলানিউজকে জানান, একটি পাত্রী চাই পোস্টের মাধ্যমে এক নারীর সঙ্গে তার অনলাইনে পরিচয় হয়। পরে অনেক কথোপকথোনের পর আমরা দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই। দেখা করতে আসার খরচ হিসেবে ওই মেয়ে আমার থেকে ১ হাজার টাকা দাবি করে। পরে আমি বিশ্বাস করে টাকা দেওয়ার পর সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।  

প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে একটি গ্রুপের এডমিন সায়মন খন্দকার বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৭ সালে আমি আর আমার এক বন্ধুকে নিয়ে এই গ্রুপটা খুলি। এই গ্রুপ থেকে আমরা কখনো কারো সাথে আর্থিক লেনদেন করি না। সম্পূর্ণ জনকল্যাণের এই গ্রুপটি আমরা পরিচালনা করে আসছি। প্রতারণার যে বিষয়টা বলা হচ্ছে এক্ষেত্রে আমাদের আগে থেকে কিছু করার থাকে না। এই ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে তখন আমরা অভিযুক্ত মেম্বারকে গ্রুপ থেকে অবাঞ্ছিত করি। এই বিষয়ে পাত্র-পাত্রী খোঁজা মানুষদের আরও বেশি সতর্কতার সাথে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সহজেই কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না।

 ব্যতিক্রম পাত্র-পাত্রী দুজনেই হবে ঢাবিয়ান

২০২০সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে পছন্দসই সঙ্গী নির্বাচন করতে পারেন সে লক্ষ্যে দুই শিক্ষার্থী একটি ফেসবুক গ্রুপ গড়ে তোলেন। প্রথমদিকে কম সাড়া পেলেও ধীরে ধীরে এর প্রচার বাড়তে থাকে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২৩ হাজার।  

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৩৪৯ পোস্টের মাধ্যমে ৭১ টি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।  

গ্রুপটির উদ্যোক্তার একজন সায়েদুজ্জামান নাইম বাংলানিউজকে বলেন, এই বিষয়টি অন্য জায়গায় আরো আগে তৈরি হয়েছে। করোনার বন্ধে কাজ না থাকায় এটি করার চিন্তা করি। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে গ্রুপ খুলি। প্রথমদিকে বিষয়টিকে সবাই ট্রল হিসেবে নিবে সেটা আমরা ধরে নিই অগ্রসর হই। নতুন নতুন প্ল্যান করে নিয়ম তৈরি করি। প্রথম বিয়েটা হওয়ার পর সবার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে বিয়ের জন্য এটার উপর নির্ভর করছে। তবে আমাদের আরও অনেক কাজ বাকি। সবাইকে সচেতন করতে হবে। সবাই যেন বিষয়গুলো নরমালি নিতে পারে।

 সমাজবিজ্ঞানী-বিশ্লেষকরা যা বলছেন

প্রযুক্তির যে উন্নতি বা যান্ত্রিক উদ্ভাবনগুলো হচ্ছে তা আমাদের জীবনকে যেমন আরামদায়ক করছে ক্ষেত্রবিশেষে আবার জীবনের যে ঐতিহ্যগত একটা ধারা ছিল সেটার মধ্যেও একটা প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, অনলাইনে পাত্র-পাত্রী খোঁজার বিষয়টা তার একটা অংশ বা ধারাবাহিকতা থেকে এসেছে। আগের দিনগুলোতে ঐতিহ্যবাহী বনেদি পরিবারগুলো বিয়ে করতে নিজেদের রক্তের মধ্যেই। আস্তে আস্তে এটা গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেল এবং একসময় ঘটকদের দৌরাত্ম অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল। এখন জীবন আরও বেশি পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং মানুষের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, এখন বাবা-মায়েরাও চায় না নিজেদের সন্তানদের জীবনে খুব বেশি প্রভাব রাখতে। সামাজিক এই পরিবর্তনের ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে তেমনি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এটার একটি সুবিধা হল পিতা মাতার দায় অনেকাংশে কমে যাচ্ছে এবং নিজেদের জীবনসঙ্গী নিজেরা পছন্দ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এখন যে মাধ্যমে মানুষ জীবনসঙ্গী নির্বাচন করছে তাতে অপরিচিতির সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে অতি অল্প পরিচয়ে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের মত একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মানুষ। এতে একজন আরেকজনকে কম জানার সুযোগ পাচ্ছে এবং একটা পরিবার আর একটা পরিবারকে কম জানছে। এতে করে একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে যেটার খারাপ প্রভাব সমাজেও পড়তে পারে।  

 
ভার্চুয়াল মাধ্যমে সংঘটিত হ‌ওয়া বিবাহের সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া অনেক কম হয়, একারণে বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে মনে করেন সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বর্তমান যুগে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক অনেক কমে গেছে। যার জন্য মানুষ প্রথাগত যে পদ্ধতি আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে বা ঘটকের মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী দেখা এবং বিবাহের ব্যবস্থা ছিল সেটা অনেকাংশেই কমে গেছে। অনুরূপভাবে বিদেশেও একাই ব্যবস্থা চালু রয়েছে কলকাতায় "ম্যারেজ" নামে আলাদা একটা পত্রিকা পর্যন্ত রয়েছে। আমাদের দেশে ও সাম্প্রতিককালে এটা শুরু হয়েছে। তারপরেও এখনো গ্রামাঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে অনেক বিয়ে হয়। আমি বলব এটা একটা নতুন ধারণ। তবে এই পদ্ধতিতে পাত্র-পাত্রীর যে পারিবারিক পরিচয় অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। ফলে বিবাহতে অনেক শৈথিল্য দেখা দেয় এবং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া অনেক কম হয়। বাংলাদেশ সময় ঘণ্টা, 

বাংলাদেশ সময়: ১৪০০, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৩
এসকেবি/এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।