ড. শক্তি রঞ্জন পাল থাইল্যান্ডের খ্যাতিমান বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকক হসপিটালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন ডাক্তারি যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রর্দশনী ‘মেডএক্সেপো’-তে।
ডাক্তার শক্তি রঞ্জন পালের জন্ম বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়। ১৯৬৯ সালে তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, নোয়াখালী চৌমুহনী কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন, সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ঢাকায় পিজিতে ভর্তি হন ১৯৮১ সালে। কিছুদিন পর চলে যান দেশের বাইরে। প্রথমে কাজ করেন জাতিসংঘে, প্রায় ১৫ বছর। সেখান থেকে অবসর নিয়ে যোগ দেন ব্যাংকক হসপিটালে। ২০০১ সাল থেকে ওখানেই আছেন। এরই ভেতর অর্জন করেছেন ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি।
আপনি তো বাংলাদেশে নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন। এখানকার চলমান চিকিৎসা-ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ড. শক্তি রঞ্জন পাল : আমি বলব যে, বাংলাদেশের ডাক্তারদের মেধার কোনও অভাব নেই। কিন্তু মেধা দিয়ে সবকিছু হয় না। মেধার সাথে সাথে অন্য কিছু জিনিস আছে, সেগুলোও দরকার। যেমন, প্রযুক্তি। আমাদের দেশে কিছু উন্নত প্রযুক্তির অভাব আছে। এ কারণে যথাযথভাবে রোগ নির্ণয় করতে ডাক্তারদের অসুবিধা হচ্ছে।
এরপর বলব, ডিসিপ্লিনের কথা। রোগী বেশি হওয়ার জন্য হোক, অথবা নিজেদের ব্যস্ততার কারণে হোক, হয়তো তারা রোগীদের ভালো করে সময় দিতে পারেন না। এর ফলে হয়তো তারা চিকিৎসা ঠিকই দেন, কিন্তু রোগীর মনে হয়তো সন্দেহ বা অসন্তুষ্টি থেকে যায়। তারা হয়তো মনে করেন তাদের চিকিৎসা ঠিকমতো হয়নি।
এরপর বলা যায়, হাসপাতালের ভেতরের অবস্থা। আসলে ডাক্তার একা চিকিৎসা করেন না। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পাশাপাশি আরো যে টিম সদস্য থাকে, নার্সিং কেয়ার থাকে সেগুলোও দরকার। তাই যারা বিদেশে চিকিৎসার পরিবেশ সম্পর্কে জানেন, এখানকার অনিয়ম দেখে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়। তাদের অসন্তুষ্টি বাড়ে।
তাই দেখা যায়, যেসব রোগীর আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তারা দেশের বাইরে চলে যান। দেশে হয়তো জরুরি চিকিৎসাটা নেন, তারপর বিদেশে চলে যান।
আমরা যদি এশিয়ার অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে, আমাদের প্রতিবেশি ভারত, সিঙ্গাপুর অথবা থাইল্যান্ডের চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করি...
ড. শক্তি : প্রথমে যদি ভারতের কথা বলি, তাহলে বলব, ভারত একটি বড় দেশ। সে দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের দেশের তুলনায় ভালো, আবার কিছু কিছু অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে ভালো নয়। সেখানে কিছু কিছু হাসপাতাল আন্তর্জাতিক মানে উঠে গেছে। সেগুলো কিন্তু প্রায় সবই বেসরকারি।
আমাদের দেশে, বিশেষ করে, ঢাকার কিছু কিছু হাসপাতাল উন্নত প্রযুক্তি এনেছে। আমি বলব যে এগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, ‘লার্নিং কার্ব’। তারা প্রযুক্তির ব্যবহার শিখছে। ডিসিপ্লিন শিখছে। সেবার মনোভাব আনার চেষ্টা করছে। আস্তে আস্তে উন্নত হবে এবং উন্নত হতে সময় লাগে।
কিন্তু থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল অনেক এগিয়ে গেছে।
একটা অভিযোগ রয়েছে, আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একটি দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষদের পক্ষে এটা কতটুকু বহনযোগ্য?
ড. শক্তি : আমার বিশ্বাস, যতদিন পুঁজিবাদের বিস্তার থাকবে ততদিন ধনী-গরিবের ব্যবধান থাকবে। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা এই ব্যবধানকে সমান করতে পারব না। তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো যখন উন্নত প্রযুক্তি আনে, তখন সরকারের ওপর একটা চাপ পড়ে। তারা সরকারকে উন্নত চিকিৎসার পথ দেখিয়ে দেয়। সরকার তখন এসব প্রযুক্তি আনতে চেষ্টা করে।
একসময় থাইল্যান্ডের চিকিৎসাব্যবস্থা এমন ছিল। বেসরকারি হাসপাতালগুলো ছিল বেশ উন্নত আর সরকারি হাসপাতালগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। এখন সরকার সেখানে ‘থার্টি বাথ হেলথ স্কিম’ চালু করেছে। সরকার এই তিরিশ থাই মুদ্রায়, যা বাংলাদেশে প্রায় ৭০ টাকা, ছোট-বড় সব ধরনের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। এই সামান্য টাকায় সরকার সবাইকে চিকিৎসা দিচ্ছে। সেটা সর্দিজ্বরের চিকিৎসাও হতে পারে, আবার হার্ট-সার্জারির চিকিৎসাও হতে পারে।
এই ধরনের ব্যবস্থা হয়তো আমাদের দেশেও একদিন আসতে পারে।
আমাদের দেশে ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাই দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। আসলে কী হওয়া দরকার?
ড. শক্তি : ভুল চিকিৎসার বিষয়টি বড়ই জটিল। কেননা, একজন চিকিৎসককে যদি ভুল চিকিৎসার জন্য বিচার করতে হয় তাহলে বিচারককে আগে জানতে হবে কোনটা সঠিক চিকিৎসা আর কোনটা ভুল চিকিৎসা। এমনকি চিকিৎসকরাও সবসময় বলতে পারেন না তিনি কেন এই ব্যবস্থা নিয়েছেন অথবা কেন নেননি। আমারই এক রোগী আমাকে বললেন, তাকে দুই ডাক্তার দুই রকম পরামর্শ দিয়েছেন। আর আমি তৃতীয় ডাক্তার হিসেবে কোনও মতামত দিইনি।
তাই বলি, বিষয়টি খুব জটিল। এ বিষয়ে আইন করার আগে দেখতে হবে দেশে যোগ্য বিচারক আছেন কিনা। এবং যোগ্য আইনজীবী আছেন কিনা। এমন অনেক দেশে দেখা গেছে, এক আদালত রায় দিয়েছে ‘এটি ভুল’ আবার অন্য আদালত একই বিষয়ে রায় দিয়েছে ‘এটি ভুল নয়’।
তবে জনগণের চিকিৎসা-নিরাপত্তার জন্য কিছু আইন করা যেতে পারে, যেগুলোতে এত জটিলতা থাকবে না।
চিকিৎসাবিদ্যার অনেক সাফল্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে আছি শুধুই কি দারিদ্র্যের কারণে?
ড. শক্তি : দারিদ্র্য অবশ্যই একটা অন্তরায়, তবে এটি কোনও সীমাবদ্ধতা নয়। আমি নিজে হেলথ ইকোনমিস্ট। থাইল্যান্ডে আমি একটা প্রকল্পে কাজ করেছিলাম। এর নাম ছিল ‘পাবলিক-প্রাইভেট মিক্সড’। সেবার মান বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করে। যাদের অর্থসামর্থ্য আছে তারা ব্যয় করবে আর তাদের ব্যয়ের একটা অংশ থেকে গরিবদের চিকিৎসাব্যয় মেটানো হবে। তারা ধনী-গরিব উভয়কেই চিকিৎসা দেবে।
এই ব্যবস্থাটি এখন থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বাস্তবায়ন করছে।
বাংলাদেশের রোগীদের জন্য থাইল্যান্ডে কেমন চিকিৎসাসুবিধা দেওয়া হয়? বিশেষ করে, আপনার ব্যাংকক হসপিটালে?
ড. শক্তি : বাংলাদেশের রোগীরা থাইল্যান্ডে অনেক সুবিধা পান। প্রথমত, তারা সরাসরি বিমানে ব্যাংকক যেতে পারেন। এরপর বলা যায়, থাইল্যান্ডের জনগণ খুবই শান্তিপ্রিয় এবং অতিথিপরায়ণ। তাদের সদাহাস্য চেহারা রোগীরা খুব পছন্দ করেন।
এছাড়া, আমরা বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাদেশি স্টাফ রেখেছি যারা রোগীদের সুব্যবস্থার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকেন। ফলে রোগীদের ভাষাগত কোনও সমস্যা হয় না। আমরা বাংলাদেশি রোগীদের আর্থিক সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে তাদের যতদূর সম্ভব স্বল্পমূল্যে ভালো সেবা প্রদান করি।
আমাদের নাগরিক জীবনে খাদ্যাভ্যাস ও ব্যস্ততার কারণে অনেক শারীরিক ও মানসিক রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পেতে পারি?
ড. শক্তি : ‘নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়’ প্রবাদটি আমরা সবাই জানি কিন্তু কতটুকু মানি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
প্রথমত, আমাদের আগে ঠিক করে নিতে হবে, আমরা সুস্বাদু খাবার খাব, নাকি স্বাস্থ্যকর খাবার খাব। সবসময় সব সুস্বাদু খাবার স্বাস্থ্যকর নাও হতে পারে। আমরা সুস্বাদু খাবার মাঝে মাঝে খাব আর স্বাস্থ্যকর খাবার সবসময় খাব।
দ্বিতীয়ত, ব্যায়াম করা। শরীর হলো একটা যন্ত্রের মতো। এই শরীরটাকে যদি ঠিকমতো পরিষ্কার না রাখি তাহলে মরচে পড়ে যাবে। ব্যায়ামের কথা বললেই সবার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, রমনা পার্কে ব্যায়াম করা। আমরা ঘরের ভেতর হালকা ব্যায়ামও করতে পারি।
তৃতীয়ত, আজকাল অনেক রোগ প্রতিরোধযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই রোগগুলোকে আগেভাগেই শনাক্ত করে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যেমন ধরুন, ক্যান্সার বা হৃদরোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা নেওয়া। বিশ্বাস করুন, যদি এসব রোগ আগেভাগে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে এগুলো প্রতিরোধ করা খুবই সহজ।
আরো অনেক ছোটখাটো বিষয় আছে। এগুলো মেনে চললেই অনেক সুস্থ থাকা যাবে।
তবে আমি খাবারের ব্যপারে বলতে চাই যে, যারা খাদ্য পরিদর্শক আছেন তারা যেন ভেজাল খাবার প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেন।
আপনার কথার সূত্রেই জানতে চাই, এই জটিল রোগের প্রতিরোধটাও কি ব্যয়বহুল?
ড. শক্তি : এটা মোটেও ব্যয়বহুল নয়। আসলে আমরা যদি নিয়মিত চেক-আপ করি তাহলেই কিন্তু প্রতিরোধটা সহজ হয়। এখন বলবেন, চেক-আপের খরচ। কিন্তু আমি বলব, এই চেক-আপের সামান্য খরচ ভবিষ্যতে আপনার অনেক খরচ বাঁচিয়ে দেবে। অর্থাৎ, চেক-আপ করতে যদি আপনি ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ না করেন, তাহলে পরে বড় কিছু ঘটে গেলে তো আপনাকেই লাখ টাকা খরচ করতে হবে।
কেউ একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে তার কর্মক্ষমতা অনেক কমে যায়। তখন সব দিক থেকেই কিন্তু ক্ষতি হয়। তাই যদি আগে থেকেই আমরা সচেতন থাকি, রোগ নির্ণয় করি, সেগুলোকে আগেভাগেই প্রতিরোধ করি, তাহলে সবদিক থেকেই আমরা লাভবান হব।
আজকাল এই নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষার বিষয়ে অনেক গরিব দেশের জনগন সচেতন হচ্ছেন। আমাদের দেশের জনগণকেও সচেতন হতে হবে। এই সচেতনতার অভাবে দেখবেন আমাদের দেশে অনেক ধনী ব্যক্তিও হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।
সব শেষে, আপনার কাছে পরামর্শ নেব কীভাবে আমরা সুস্থ থাকতে পারি?
ড. শক্তি : প্রথম হলো সুস্থ থাকার জন্য আগে দরকার সুস্থ মন। সুস্থ থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। আমি খানিক আগে এই কথাগুলো বলেছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করা। কিন্তু মানসিকভাবে কেউ যদি তা মানতে না চায় তাহলে কিই-বা করার আছে! ধূমপান ক্ষতিকর জেনেও অনেক ডাক্তার সিগারেট খেয়ে থাকেন। তাই বলি, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।
সমষ্টিগতভাবে আমরা এই কাজ করতে পারি। আমরা হেলথ ক্লাব করতে পারি।
সবশেষে বলব, আমাদের সুস্থ থাকাটা কঠিন কিছু না। নিজেকে সুস্থ রাখা বহুলাংশেই নিজের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ সময় ১৪৫০, ডিসেম্বর ১৮, ২০১০