ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

সময় বিভ্রাট ও বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা!

জাবেদ ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১০

গত কয়েকবারের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে চলেছে তুঘলকি কারবার। প্রমোশনাল আর পত্রিকার পাতায় দেওয়া সময় অনুযায়ী অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে খুব কমই।

সেই সঙ্গে ছিল বরাবরের মতো বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা। বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে গেছে অনুষ্ঠান। আবারও দর্শকদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে, অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন, নাকি বিজ্ঞাপনের ফাঁকে অনুষ্ঠান!

ঈদের অনুষ্ঠান নিয়ে চ্যানেলগুলোর খেয়ালিপনা আর অতি বাণিজ্যিক মনোভাবের সমালোচনা কেবল দর্শকদের মধ্যেই নয়, খোদ টিভি তারকা আর নির্মাতাদের মধ্যেই রয়েছে। সেগুলো জানার আগে চ্যানেলগুলো আসলে কী করে, তার কিছু নমুনা এবারের ঈদ অনুষ্ঠানের আলোকে আসুন দেখে নেওয়া যাক।

ঈদের দিন, রাত নয়টা। আরটিভিতে প্রচারিত হবার কথা রেদোয়ান রনির রচনা ও পরিচালনায় নাটক সারমেয়। কিন্তু শুরু হলো প্রায় ১০ মিনিট পর। আর ৪৫ মিনিটের এই নাটক শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় ২ ঘণ্টা!

ঈদের দ্বিতীয় দিন, বিকেল সাড়ে ৫টা । চ্যানেল আইতে প্রচার হবার কথা খালিদ মাহমুদ মিঠুর রচনা ও পরিচালনায় নাটক ‘হৃদয়ের ছবি’। শুরু হলো প্রায় ১৫ মিনিট পর। ১০ মিনিট নাটক দেখানোর পর ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন। ৪৫ মিনিট ব্যাপ্তির এই নাটকের প্রচার শেষ হয়েছে প্রায় সাড়ে সাতটায়।

ঈদের তৃতীয় দিন, রাত ১০টা ৩৫ মিনিট। বৈশাখী টিভিতে প্রচার হওয়ার কথা রুম্মান রশীদ খানের রচনা ও  কৌশিক শংকর দাসের পারচালনায় নাটক ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা নাটক’। প্রায় ১০ মিনিট  পেরিয়ে গেল। কিন্তু বিজ্ঞাপন আর থামে না। শেষে প্রায় ১৫ মিনিটের পর শুরু হলো নাটক প্রচার। ৫ মিনিট নাটক দেখানোর পর পর চলল ১০-১২ মিনিট ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার। ফলে নাটকের অবস্থা দাঁড়ালো কাটাছেঁড়া করা গাঁজাখুরি গল্পের মতো। অংশবিশেষ বাদ দিয়ে পুরো নাটকটি দেখানো হয়েছে ২০ মিনিটের মতো।

উপরের উদাহরণগুলো তুলে ধরা হয়েছে একদম ঘড়ি ধরে। তবে এর বাইরেও সব টিভি চ্যানেলের নাটক, টেলিফিল্ম, ছায়াছবি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে চিত্রটা কমবেশি প্রায় একরকমই। ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠানের মধ্যে তিন দফায় বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে ৪৫ মিনিট। ৭৫ মিনিটের টেলিফিল্ম শেষ হচ্ছে শুরুর তিন ঘণ্টা পর। এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর ঈদ আয়োজনের অবস্থা। দর্শকদের অভিযোগ, গত রোজার ঈদের চেয়ে এই কোরবানির ঈদে অনুষ্ঠানে মাঝে বিজ্ঞাপন প্রচারের হার আরো বেড়ে গেছে।
 
ঈদে বিনোদনপ্রত্যাশী দর্শক টিভি সেটের সামনে বসে বিরক্ত হচ্ছেন চরমভাবে। লম্বা বিজ্ঞাপন বিরতির কারণে কোনো নাটক বা অনুষ্ঠানে তার মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে ােভ প্রকাশ করেছেন বেশ কজন নাটক ও অনুষ্ঠান নির্মাতাও।

বাংলানিউজের কাছে এ বিষয়ে নিজের মত জানিয়ে নাটক-নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রচার নীতি অনুযায়ী প্রতি ৩০ মিনিটের অনুষ্ঠানে সর্র্বাধিক ৭ মিনিট বিজ্ঞাপন থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের চ্যানেলগুলো এই নীতি মেনে চলছে না। এভাবে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করলে দেশের দর্শক কমে যাবার সম্ভবনা আছে।

নাট্যপরিচালক মোস্তফা কামাল রাজ বললেন, অনেক দর্শকই অভিযোগ করেন যে, দীর্ঘ বিজ্ঞাপনের কারণে তারা নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমার তো মনে হয়; নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপন নয় বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক দেখানোটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অনেক সময় নিলেও আমার নাটকে কাট-ছাঁট হয়নি। কোনো কোনো সহকর্মী নির্মাতার কাছ থেকে তাদের নাটক কাট-ছাটের অভিযোগ শুনেছি।

এ প্রসঙ্গে নির্মাতা ইফতেখার আহমেদ ফাহমী বলেন, চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতিতে প্রচার করুক। আর নাটকে কাট-ছাট করলে অনেক দৃশ্যেরই মিল থাকে না, তখন অনেকে বলে নাটক ভালো হয়নি। আর নির্মাতার অনুমতি ছাড়া কাটাছেঁড়াটা মোটেও ঠিক নয়।

নির্মাতা কৌশিক শংকর দাশ বলেন, দর্শক হিসেবে আমি যখন টিভির সামনে বসি প্রোগ্রাম দেখার জন্য, বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন দেখে চরমভাবে বিরক্ত হয়ে পড়ি। নিজের নাটকই দেখতে ইচ্ছে হয় না অনেক সময়, দর্শকদের কথা কী বলব। ইদানীং নাটক কেটেছেঁটে সংক্ষিপ্ত করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে।   নাটক কেটে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করলে নাটকের কিছুই থাকে না। নাটকের গল্পই এলোমেলো হয়ে যায়, দর্শক কিছুই বুঝতে পারে না।

টিভি অনুষ্ঠানের মধ্যে লম্বা বিজ্ঞাপন বিরতি প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রায় সব চ্যানেল কর্তৃপরে এক কথা, বিজ্ঞাপন প্রচার কমানোর কোনও উপায় তাদের সামনে নেই । তাদের দাবি,  দিন দিন বিজ্ঞাপনের  রেট কমছে। বিজ্ঞাপনদাতারা চ্যানেলের চাহিদামাফিক রেট দিতে চাচ্ছেন না। তাই প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরে রাখতে চ্যানেলগুলো অনেকটা বাধ্য হয়েই বিজ্ঞাপন প্রচারের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের রেট এফএম রেডিওর চেয়েও কম।

এ বিষয়ে দেশটিভির অনুষ্ঠান প্রধান পারভেজ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের সব চ্যানেলই ফ্রি চ্যানেল। তাই নিজেদের আয় নিজেকে করতে হয় আর বিজ্ঞাপনই আমাদের প্রধান উৎস। তাছাড়া বিশেষ দিনগুলোতে বেশি বাজেটের ভালো নাটক বা অনুষ্ঠান থাকে, তাই বিজ্ঞাপনটা একটু বেশি প্রচার করতে হয়।

বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান শামীম শাহেদ বলেন, অন্যান্য টেলিভিশন থেকে তুলনামূলকভাবে কম বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছে বাংলাভিশনে। এমনকি আমরা বিজ্ঞাপন রেট বাড়িয়ে দিয়েছি এবং তাতে সফলও হয়েছি।

আরটিভির অনুষ্ঠান প্রধান মিনহাজুর রহমান বলেন, বিজ্ঞাপন যেন দর্শকের বিরক্তির কারণ না হয় সেদিকে নজর দিতে চাইলে চ্যানেল টিকিয়ে রাখা কঠিন। ব্যবসায়িক স্বার্থে বিজ্ঞাপন প্রচার করতেই হবে। যদি কারো ভাল না লাগে তাহলে চ্যানেল পাল্টালেই হয়। আমাদের কিছু করার নেই।

বর্তমানে দেশে এখন ১৩টি স্যাটেলাইট চ্যানেল রয়েছে। খবর, নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতানুষ্ঠান, টক শোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেশির ভাগ চ্যানেলই ২৪ ঘণ্টা অন ইয়ারে থাকছে। পাশাপাশি রয়েছে সংবাদ। টিভি চ্যানেলের সুপার পিক টাইম ধরা হয় যে সময়টাতে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে বিজ্ঞাপনের অতি ব্যবহার। অথচ এ সময়ই দর্শক টিভিসেটের সামনে আসে। বিশেষ করে নাটক প্রচারের সময়টাতে কমার্শিয়াল ব্রেকের নামে টানা বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞাপনের এই আধিক্যের অনেক ভালো নাটক বা অন্য অনুষ্ঠানও দর্শক দেখতে বসে শেষ করতে পারে না। ধৈর্য হারিয়ে অনেক দর্শকই  চলে যান বিদেশি চ্যানেলে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭১৫, নভেম্বর ২১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।