এবছরের শুরুর দিকের ঘটনা। চাকরির সুবাদে তখন বরিশালে বসবাস।
অফিস বন্ধ তাই বলে সময়টাতো আর শুয়ে বসে কাটানো যায় না। নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম অজানা গন্থব্যের পথে। উদ্দেশ্য একটাই দুচোখ ভরে গ্রাম বাংলার অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করা। নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে এসেই একটা খুলনার বাস পেয়ে উঠে বসলাম। বাসে বসেই জানতে পারলাম বাস যাবে গোপালগঞ্জ হয়ে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম টুঙ্গীপাড়া যাওয়ার। যাত্রা শুরু হল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা। অনেকটা কচ্ছপ গতিতেই বাস চলতে লাগলো। পৌঁছাতেই দুপুর। গোপালগঞ্জ নেমেই প্রথমে যথারীতি শহরটা একটু ঘুরে দেখলাম। এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে টুঙ্গীপাড়ার বাসে চড়লাম।
নিলফা বাজার পেড়িয়ে মধুমতি নদীর তীরে পাটগাতি হয়ে টুঙ্গীপাড়া। রাস্তার অবস্থা বেশ ভালো। এখানেই শায়িত আছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিশাল এলাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স। এত বড় আর এতোটা গোছানো তা অবশ্য ভাবিনি। অনেকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে ঘুরলাম।
সমাধি কমপ্লেক্সের পাশেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। রাস্তা ধরে কিছু দূর এগুতেই চোখে পড়লো লাইব্রেরি ভবণ। ঐতিহাসিক ছবিসহ গ্যালারি ও নানা বই পুস্তক সম্বলিত লাইব্রেরি রয়েছে এখানে। পাশে চমৎকার স্থাপত্যের একটি মসজিদও রয়েছে। সব মিলিয়ে ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ জায়গা। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে নির্জন নিরিবিলি এই উপজেলার আশেপাশের গ্রাম, ধানক্ষেত, নদী যে কাউকে মোহিত করবে নিশ্চিত। এমন মাটির সন্তানইতো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হওয়ার যোগ্য। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই ফেরার তাগিদে রওয়ানা হলাম।
এরকম ট্যুরে আমি সাধারণত যে পথ দিয়ে আসি সে পথে না ফিরে অন্য রাস্তা দিয়েই ফেরার চেষ্টা করি। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল কোটালিপাড়া হয়ে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট নামক জায়গা দিয়ে বরিশাল যাওয়া যায়। তবে সে পথে যেতে হলে বেশ খানিকটা ভোগান্তি পোহাতে হবে। তাতে কি? আমি তো ভ্রমণে অ্যাডভেঞ্চারই পছন্দ করি। দ্বিতীয় বার না ভেবেই পা বাড়ালাম।
কোটালীপাড়া যাওয়ার রাস্তা হল এক ধরনের টেম্পু। রাস্তার অবস্থাও খুব ভালো নয়। অবশ্য ঠিক করবে বলেই প্রস্তুতি চলছে শুনলাম। রাস্তার দুপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই, শুধুই জলাধার যেখানে বছরে একবার ফসল হয়। পাক্কা এক ঘণ্টা পর এই যাত্রা শেষ হলো। মাঝবাড়ি থেকে শেষ বাস ভাগ্য ভালো হলে পাওয়া সম্ভব হবে। ভাগ্য সহায় হলো, অবশেষে বাস পাওয়া গেল। বাসের অবস্থা তুলনামূলক ভালোই। বাস নামিয়ে দিল পয়সার হাট নামক এক জায়গায়। সেখান থেকে নদী পার হয়ে বরিশালের পথে যেতে হবে। নদী পার হওয়ার আগে বাজারে গরম গরম জিলাপী দেখে আর লোভ সামলানো গেলোনা। জিলাপী নিয়েই নৌকাতে উঠে বসলাম। ঐ পাড়ে নেমে দেখি আরেক বিপদ। কোন যানবাহন নেই। দু-চারটে মটর বাইক আছে কিন্তু এই তীব্র শীতে ক্ষ্যাপ না মেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার ক্রিকেট খেলা দেখতেই তারা বেশি আগ্রহী।
যাই-হোক দৈবক্রমে একটি ভটভটি জাতীয় যান পাওয়া গেল যেটা আগৈলঝাড়া যাবে। আবার যাত্রা শুরু। শীতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। আর নিজেকেই নিজে তিরস্কার করছিলাম এরকম সিদ্ধান্তের জন্য। অবশেষে পৌঁছলাম আগৈলঝাড়া কিন্তু এখানে এসেও হতাশ হতে হলো,বরিশালের কোনো বাস নাই। লোকজন বুদ্ধি দিল গৌরনদী গেলে নাকি বাস পাওয়া যাবে। তখন রাত প্রায় নয়টা। আগৈলঝাড়া থেকে মুড়ির টিন জাতীয় টেম্পুতে করে রওয়ানা হলাম গৌরনদী। রাস্তাঘাট ভালোই। গৌরনদী পৌঁছে ভাবলাম যাক এযাত্রায় মনে হয় বাঁচা গেল। কিন্তু না! দুর্ভোগের এখানেই শেষ নয়। রাত দশটায় লং রোডের কোনো বাসের আসা যাওয়া নেই। প্রায় ৪৫ মিনিট বসে থাকার পর একটি বাসে উঠতে পারলাম। ইলিশ নামের এই বাসটিকে তখন আমার মনে হচ্ছিল কোন স্বর্গিয় যান। অবশেষে প্রায় মাঝরাতে ফিরে এলাম বরিশাল। আর এভাবে আমার আরেকটি গন্থব্যহীন ঘোরাঘুরি শেষ হলো।
প্রিয় পাঠক আপনাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনারা টুঙ্গিপাড়ায় আসতে পারেন খুব সহজে। ঢাকা থেকে যারা গোপালগঞ্জ হয়ে টুঙ্গিপাড়া যেতে পারেন। গুলিস্তান থেকে গোপালগঞ্জের বিআরটিসি এসি বাস রয়েছে। এছাড়া কোটালীপাড়া হয়েও টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে ‘দোলা পরিবহন’ এবং ফুলবাড়িয়া থেকে ‘টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস’ নামে টুঙ্গীপাড়ার সরাসরি বাস সার্ভিসও রয়েছে। বাস ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ ঘণ্টার মত সময় লাগতে পারে। রাত্রি যাপনের জন্য আশেপাশে পর্যটনের একটা রেস্টহাউস ছাড়াও আরো কিছু রেস্টহাউসও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স ছাড়াও গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য দেখে কাটিয়ে যেতে পারেন কিছু সময়।
ফরিদ ফারাবী
farid_farabi@yahoo.com