বছরে কত দিবসই না পালন করে মানুষ। তার মধ্যে থাক না একটি দিবস শুধু ভালোবাসার নামে।
ভালোবাসা দিবসের নেপথ্যে
ভ্যালেন্টাইন’স বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক রহস্যময় ইতিহাস। এর কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা তা আজ আর হলফ করে বলার কিছু নেই। অনেকের মতে, যিশু খ্রিস্টের জন্মের ২৭০ বছর পর কোনো এক সময় তৎকালীন রোম স¤্রাট দ্বিতীয় কদিয়াসের মনে হলো যুদ্ধে বিবাহিত লোকজন কোনো কাজের নয়। তাদের অনেক পিছুটান। এজন্য তিনি আদেশ জারি করলেন, ‘তরুণরা আর বিয়ে করতে পারবে না। সে সময় রোমে বাস করতেন ভ্যালেন্টাইন নামে এক পাদ্রী। তার মনে হলো স¤্রাটের এ আদেশ অত্যন্ত বেআইনি। তাই তিনি গোপনে তরুণদের বিয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে লাগলেন। ব্যাপারটা জানতে পেরে স¤্রাট দ্বিতীয় কদিয়াস মৃত্যুদ- দেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, সে আমলে খ্রিস্টানদের রোম কারাগারে আটকে রেখে ভয়ানক নির্যাতন করা হতো। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এসব বন্দিকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন বলে স¤্রাট তাকে গিলোটিনে হত্যা করেন। আবার কেউ বলেন, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নিজেই কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং তিনি সেই কারাপ্রধানের কিশোরী কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি সেই কিশোরীকে ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’ লেখা পত্র পাঠিয়েছিলেন (লোকে বলে, সেটাই বিশ্বের প্রথম ভ্যালেন্টাইন কার্ড এবং এই বাক্যটি ভ্যালেন্টাইন দিবসের কার্ডে আজও লেখা হয়। )
এর অনেক পরে ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ গেলসিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণভোজের দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। আবার অনেকে বলেন, দিনটির সাথে ভ্যালেন্টাইনের সম্পর্ক নেই। পত্রিকামতে, ১৪ ফেব্রুয়ারি বসন্তের প্রথম দিন। তাই এ দিনটি পালন করা হয়।
অনেকে বলেন, ভ্যালেন্টাইন এসেছে ইতালির সুপারসেলিস উৎসব থেকে। অন্যদিকে ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডের লোকদের ধারণা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বসন্তের প্রথম দিনে পাখিরা পরস্পরের প্রতি প্রেম নিবেদন করে। এই ধারণা থেকেই লোকে পাখিদের প্রেম নিবেদন ভঙ্গিসম্বলিত ছবি আঁকা কার্ডে প্রেমের কবিতা লিখে পাঠাতেন মনের মানুষের কাছে।
১৮৪০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ইস্টার হাওল্যান্ড নামে একটি কোম্পানি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভালোবাসা দিবস হিসেবে ভ্যালেনটাইন কার্ডে বাজার সয়লাভ করে দেয়। বলা যায়, সেই থেকে সারা বিশ্বে দিনটি জনপ্রিয় হতে থাকে।
এ ভ্যালেন্টাইন, সে ভ্যালেন্টাইন নয়
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন শুরু হলেও পরবর্তীকালে এ দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য বিকৃত হয়। দিবসটির ধর্মীয় তাৎপর্য ধর্মবিরোধীদের কর্মকা-ের চাপে চাপা পড়ে যায়। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে দেশে ভ্যালেন্টাইন ডের উদ্ভব ঘটেছে সে দেশের তরুণ-তরুণীরা কিন্তু আমাদের মতো এ দিনটিকে উদযাপন করে না। অবশ্য পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশে এ দিবসটির গুরুত্ব অনেক। কারণ তাদের সামাজিক বন্ধন আমাদের মতো সুদৃঢ় নয়। তারা কেবল অর্থ উপার্জন আর ভোগবাদে বিশ্বাসী। তাদের পরিবার প্রথা ভেঙে গেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সবচেয়ে অনুকরণীয় ও আদর্শস্থানীয় দেশ আমেরিকায় প্রতি ৪৬ সেকেন্ডে একজন নারী ধর্ষিত হয়। তারা বলে, আমেরিকা সভ্যতার দেশ। অথচ দেশটির ৪৩ ভাগেরও বেশি মানুষ অবৈধ সন্তান। তারা বলে, আমেরিকা সোনার হরিণের দেশ। অথচ সেখানেই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। (মোরা বড় হতে চাই : আহসান হাবিব ইমরোজ, পৃষ্ঠা-৫)। আঠারো বছর বয়স হলেই তাদের পুত্র-কন্যারা পরিবার ছাড়া হয়ে আলাদাভাবে বসবাস করতে থাকে। আবার বাবা-মা অক্ষম কিংবা বৃদ্ধ হলে তারা সন্তানের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তখন তাদের আশ্রয়স্থল হয় বৃদ্ধাশ্রম কিংবা ভবঘুরে কেন্দ্রে। কাজেই একদিনের ভালোবাসা বা উপলক্ষ তাদের জন্য খুব দরকার।
‘ভালোবাসা দিবস’ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি মূল্যায়ন তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, ‘আমি একদিন নয়, ৩৬৫ দিনই ভালোবাসি। আর আমার ভালোবাসা চিরদিনের, একদিনের নয়। তাই প্রতিদিনই আমার ভ্যালেন্টাইন। ভালোবাসা আমার কাছে উপলব্ধি বা টানের ব্যাপার। এটা শুধু যে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমিত থাকবে তা নয়। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা আছে আমার। তাদের জন্য কিছু করার তাড়নাটাই তো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ’
এবং বিশ্ব ভালোবাসা দিবস
সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীদের মাঝেও এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যম-িত হয়ে উঠেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। এদিন তরুণ-তরুণীদের মনে থাকে ফাগুনের আগুন আর ভালোবাসার মর্মিত শিহরণ। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ শব্দটির গভীর ব্যঞ্জনা কজন হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। কারণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘ভালোবাসা’ নামক শব্দটির সংজ্ঞার্থ হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়...? প্রশ্ন ওঠে, সত্যিই কি তিনি জানতেন না? অথবা জেনেও এই রহস্যের লুকোচুরি খেলেছেন? রবীন্দ্রনাথের এই সংশয় প্রকাশের পর, ভালোবাসা সম্বন্ধে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, প্রথাগত যে সম্পর্ককে আমরা ভালোবাসা হিসেবে চিহ্নিত করি, তা-ই শুধু ভালোবাসা নয়। ভালোবাসার অর্থ আরো ব্যাপক, আরো গভীর।
তবে বিশেষ একটি দিনকে ভালোবাসার নামে উৎসর্গ করে পৃথিবীব্যাপী মানুষ যদি সেই দিনটিতে হিংসা হানাহানির পরিবর্তে হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারেন, ভালোবাসার স্বর্গীয় সৌরভ তা হলো মন্দ কি? আর না পারলেও যদি সেই চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করা হয়, তাও তো দোষের নয়।
বাংলাদেশ সময় ০০১৫, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১১