ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

লন্ডনে হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের বিদায় সংবর্ধনা

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪
লন্ডনে হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের বিদায় সংবর্ধনা

লন্ডন: হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের যোগ্যতা ও দক্ষতা কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। তিনি লন্ডন ত্যাগ করলেও তার এই ঔজ্জ্বল্য এখন ছড়াবে পৃথিবীর আরেক প্রান্ত ব্রাজিলে।



রোববার পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের সম্মানে আয়োজিত এক নাগরিক বিদায় সংবর্ধনায় বক্তারা এ  মন্তব্য করেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড শেখের সভাপতিত্বে এবং সংস্কৃতিকর্মী ইয়াসমীন পলিন ও স্নিগ্ধা সাজিয়ার যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই বিদায়ী অনুষ্ঠানে রাজনীতিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস ছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন- প্রবীণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার খোন্দকার এম তালহা, বাংলা টিভি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ সামাদুল হক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক, চ্যানেল আই ইউরোপের এমডি রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শুয়েব, জাসদ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবুল মনসুর লীলু ও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি সৈয়দ মাহাথির পাশা প্রমুখ।

কমিউনিটির পক্ষ থেকে বিদায়ী হাইকমিশনারের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন সৈয়দা রেখা। এর আগে নৃত্যের তালে তালে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করে বিদায়ী হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসকে অনুষ্ঠানে বরণ করা হয়।
 
অনুষ্ঠানের সভাপতি লর্ড শেখ মিজারুল কায়েসকে একজন ‘এক্সিলেন্ট’ কূটনীতিক মন্তব্য করে জানান, ব্রিটিশ পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন ফোরামে এই মেধাবী কূটনীতিকের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে তার অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছে। সমমর্যাদার সঙ্গে ব্রিটেন ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে মিজারুল কায়েসের দায়িত্বকালটি ছিল খুবই সক্রিয়।

তিনি বলেন, সাহিত্য-সংষ্কৃতির প্রতি কায়েসের আকর্ষণ ও অগাধ পাণ্ডিত্য কূটনৈতিক অঙ্গনে বিরল মন্তব্য করে লর্ড শেখ বলেন, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাংলাদেশের এই কূটনীতিকের আলোচনার আমি একজন মুগ্ধ শ্রোতা।

তিনি মিজারুল কায়েসকে ‘এ ম্যান ফর অল সিজন’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বহু গুণে গুণান্বিত বিরল প্রতিভার অধিকারী এমন একজন কূটনীতিক পৃথিবীর যেখানেই যান, সেখানে শুধু কূটনৈতিক অঙ্গন নয়, সব অঙ্গনই সমৃদ্ধ হবে এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

মিজারুল কায়েসের সব ইতিবাচক দিকগুলোর পাশাপাশি একটি নেতিবাচক দিকও আছে বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী।

তিনি বলেন, এই নেতিবাচক দিকটি হলো, কায়েস খুব বেশি ভালো মানুষ। এই গুণটি অনেক সময় সংশ্লিষ্টদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, যা কায়েসের বেলাতেও হয়েছে। তিনি এখন তার এই ‘ভালো মানুষি’র দাদন দিচ্ছেন।

গাফ্ফার চৌধুরী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের একটি গল্প শুনিয়ে উপস্থিত সুধীদের বলেন, ফজলি আম গাছে সবাই ঢিল ছোড়ে; শেওড়া গাছে কেউ ঢিল ছোড়ে না। মিজারুল কায়েস হলেন সেই ফজলি আম। আর এজন্যই অনেকেই তার প্রতি ঢিল ছুড়েছে। এটি তাকে ‘কমপ্লিমেন্ট’ হিসেবেই নিতে হবে।

ব্রিটেনে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার সৈয়দ আব্দুস সুলতান থেকে মিজারুল কায়েস সবাইকে তিনি দেখেছেন মন্তব্য করে গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, কে কার চেয়ে বেশি যোগ্য বা দক্ষ, তা আমি বলবো না। তবে এটি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, মিজারুল কায়েস হলেন একমাত্র ‘পিপলস হাইকমিশনার’।

তিনি বলেন, মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য এই ব্রিটেনে যখন কায়েসের মতো একজন হাইকমিশনার খুবই প্রয়োজন ছিল, ঠিক তখনই তাকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। এটি খুবই দুঃখজনক!
ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার খোন্দকার এম তালহা মিজারুল কায়েসকে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের একজন ‘সেরা কূটনীতিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, আজকে তার বিদায়ী অনুষ্ঠানে কমিউনিটির শীর্ষ ব্যক্তিদের উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি কত সফল একজন হাইকমিশনার ছিলেন!

তিনি বলেন, মিজারুল কায়েসকে অন্যান্য হাইকমিশনারদের জন্য অনুকরণীয় মন্তব্য করে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার বলেন, দায়িত্ব পালনে তার কর্মকাণ্ড থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

কমিউনিটির পক্ষ থেকে দেওয়া মানপত্রে বিদায়ী হাইকমিশনারকে উদ্দেশ করে বলা হয়, কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে আপনি আজ আমাদের থেকে চলে যাচ্ছেন। নতুন দায়িত্ব গ্রহণের লক্ষ্যে আপনার এই চলে যাওয়া কষ্টকর হলেও আমরা তা মেনে নিচ্ছি। কারণ, আমরা জানি, আপনার মতো একজন মেধাবী কূটনীতিক যেখানেই যাবেন, বাংলাদেশ সেখানেই ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে। এই ঔজ্জ্বল্যতা আমাদেরই।

মানপত্রে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের হাইকমিশনার আপনি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে উন্নত বিশ্বের সম্পর্ক অনেকটা ‘গরিবের বউ, সবার ভাবি’ এই প্রবাদবাক্যটির মতো। কিন্তু এই প্রবাদবাক্যটি মিথ্যা প্রমাণে সচেষ্ট ছিল আপনার ব্রিটেনে দায়িত্ব পালনকালীন সময়টি।

৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের নির্বাচন পরবর্তীকালীন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো কোনো ব্রিটিশ রাজনীতিকের নেতিবাচক মন্তব্যের উত্তরে আপনি যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কূটনীতিকের পরিচয়ই ফুটে উঠেছে। আপনার জবাব ‘মাথা উচু রেখেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ’ এই বার্তাই দিয়েছে ব্রিটেনকে।
 
কমিউনিটি মানপত্রে বলা হয়, কূটনৈতিক দায়িত্বের পাশাপাশি বাঙালির সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ব্রিটিশ মূলধারায় আপনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তার তুলনা নেই। আপনার মেধাবী উপস্থাপনা রবীন্দ্র-নজরুলকে ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের আরো কাছে নিয়ে গেছে। এই প্রজন্মের বাংলা সংস্কৃতিবিমুখতা, বাঙালির শ্বাশ্বত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের উদাসীনতা  আপনাকে পীড়া দিতো। আর তাই তো এই উদাসীনতা প্রতিরোধে আপনি যুদ্ধে নেমেছিলেন রবীন্দ্র-নজরুল অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে।

মানপত্রে বলা হয়, নিজের অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে ব্রিটিশ মূলধারায় আপনি যেভাবে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন, ‘সেক্সপিয়র বার্থ প্লেস অনারারি মেম্বারশিপ’ প্রাপ্তির মাধ্যমে তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন আপনি।

বিদায়ী হাইকমিশনারকে বিরূপ প্রকৃতি-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর বন্ধু আখ্যায়িত করে মানপত্রে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পক্ষে আপনার উচ্চকণ্ঠ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামেও আলোড়ন তুলেছে।

চলতি বছরের প্রথম দিকে লন্ডনে ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘হাও ইজ ক্লাইমেট চেঞ্জ এফেকটিং মাইগ্রেশন অ্যান্ড হাও সুড পলিসি মেকার্স রেসপন্ড’ শীর্ষক সেমিনারের প্যানেল আলোচক হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আপনি যেভাবে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছেন, তা ছিল অসাধারণ।

উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার দায়ভার দেওয়া ও এর সমাধানে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখার যে দাবি আপনি ওই সমাবেশে রেখেছেন, তা ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি দেশেরই প্রতিধ্বনি।
মানপত্রে ‘কমিউনিটিবান্ধব হাইকমিশনার’ আখ্যায়িত করা হয়, বিদায়ী হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসকে। এতে বলা হয়, কমিউনিটি আপনাকে পেয়েছিল একজন অভিভাবক হিসেবে। সুখ-দুঃখে আপনাকে পাশে পেয়েছি আমরা প্রতিনিয়ত।

কমিউনিটিবান্ধব একজন হাইকমিশনার হিসেবে আপনাকে মনে থাকবে দীর্ঘদিন। আমরা জানি, আপনার এই বিদায় বিদায় নয়, নতুন দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দেওয়া। এই উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত বাহন আপনি। বাংলাদেশ সরকার এটি বিশ্বাস করে বলেই নতুন এই দায়িত্ব দিয়েছে আপনাকে। আপনার অর্জিত সব মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে এই বিশ্বাসের মর্যাদা আপনি রক্ষা করবেন এটিই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতাত্তোর ব্রিটেনে মিজারুল কায়েসই প্রথম হাইকমিশনার, যাকে দায়িত্ব শেষে কমিউনিটির পক্ষ থেকে এমন আরম্ভড়পূর্ণ বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হলো।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ হাইকমিশনেও মিজারুল কায়েসের বিদায় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়, বিদায়ী অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে, ব্রিটেনে নিযুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও ব্রিটিশ ফরেন অফিসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ