ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

স্টুটগার্টের চিঠি

নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোই সম্মানের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৮
নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোই সম্মানের কর্মক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষিত নারী। ছবি-সংগৃহীত

স্টুটগার্ট (জার্মানি) থেকে: পাশ্চাত্যের নারী এবং বাংলাদেশি নারীদের নিয়ে তুলনামূলক ও গঠনমূলক আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ আছে। জীবনযাত্রার মান, স্বাধীনতার মাত্রা, অধিকার, পেশা ও কর্মক্ষেত্রে সুযোগের নিরিখে বাংলাদেশ ও উন্নত বিশ্বের নারীচিত্রটিও খতিয়ে দেখার দরকার রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের নারীদের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে।

এখনও বাংলাদেশে নারীরা মূলত ঘর-সংসারকেন্দ্রিক জীবনেই অভ্যস্থ ও গণ্ডিবদ্ধ। এখন যদিও নারীরা পুরুষের পাশাপাশি ঘরের বাইরেও নানামুখী কাজকর্মে নিজেদের দক্ষতা ও মেধাকে কাজে লাগাচ্ছে, তথাপি পাশ্চাত্যের নারীদের চেয়ে এখনও অনেক পিছিয়ে তারা।

যেদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, সেদেশের নারীদের আরও বেশি কর্মমুখী হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না।

বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের কিছু সুযোগ থাকলেও থানা অথবা গ্রাম পর্যায়ে তা একেবারেই নেই বা থাকলেও অতি সামান্য। আবার এটাও ঠিক যে বাংলাদেশে নারী-শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে নারী-শ্রমের স্বীকৃতি ও সঠিক মূল্যও দেওয়া হয় না।

আমরা প্রবাসে একটি বিষয় নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করি। সেটি হলো মানসিকতা। নারীর প্রতি সম্মান ও মনোযোগ দেওয়ার ঘাটতি বাংলাদেশের ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক পর্যায়ে রয়েছে। একটি উদাহরণ দিচ্ছি বাস্তব ক্ষেত্র থেকে। জার্মানিতে আমি এবং আমার মতো প্রায়-সকল প্রবাসী বাংলাদেশি নারী নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত কাজের সঙ্গে জড়িত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কাজ করাই এখানকার সংস্কৃতি। 'বাসায় বসে বসে আমি শুধু ঘরের কাজ করি' বলে কোনো সুযোগ এদেশে নেওয়া যাবে না। কর্মক্ষম কোনও সদস্য যদি এদেশে শুধু বাসার কাজ করেন, তাহলে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।  

আর বাংলাদেশে সবার মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হলো, সংসারে অর্থ যোগান দেয়াটা পুরুষেরই দায়িত্ব আর বাচ্চা লালন পালন করা, ঘরের কাজকর্মের দায়িত্বটা নারীদের। বিদেশে আমরাও কাজ করি শুনে দেশের অনেক আত্মীয়-পরিজন চোখ কপালে তোলেন। বিশেষ করে, নারী আত্মীয়রা ভাবেন আমরা বুঝি খুব কষ্টে আছি।  

আসলে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। এখানে সবাইকে নিজ নিজ কাজ করতেই হবে। স্কুল বাচ্চাদের শিক্ষা দেবে। মায়েদেরকে বাচ্চাদের পেছনে ছুটতে হবে না। তো কাজ ছাড়া একজন মা তখন কিভাবে থাকবে? ফলে তাকেও কিছু না কিছু সময় কাজ করতেই হবে। অলস বসে থাকলেই বরং হাঁপিয়ে উঠতে হয়।

বাংলাদেশের নারীরা কোনো রকমে স্কুল-কলেজের ধাপ পার হলেই যেন অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে লাল বেনারসী পরে কারও ঘরের ঘরনি হবার । আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লেখাপড়ার ধাপ শেষ হতে না হতেই প্রবাসী বরের গলায় মালা পরিয়ে তার হাত ধরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছি। আমাদের চিরাচরিত মানসিকতার কারণে ঘরে বসে বসে বছরের পর বছর কাটিয়েছি সংসার দেখাশোনার নামে। এক সময় কাজ আমাকে টেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের নারীরা এমন সুযোগ পায় না। ঘরেই জীবন কাটিয়ে দেয়।

পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষ ঘরে ও বাইরে দুটো কাজই নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। আমার কর্তা আমার চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে। বাচ্চারা কিছুটা বড় হবার পরও যখনই আমি ইচ্ছা প্রকাশ করতাম যে বাইরে একটা চাকুরি করি, বলেছি মাত্র তার জবাব মিলতো: ‘ঘরের কাজ করে বাইরে কাজ করতে পারবে না। আরামে আছো আরামেই থাকো। ’

কী আর করা! এভাবেই আরও কয়েক বছর বেশ চলল, তারপর নিজেই উদ্যোগ নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে একটা জব পেয়েই গেলাম এবং শুরু করলাম। আমার ইউরোপিয়ান, রাশিয়ান, তুর্কি, ভিয়েতনামি, চীনা, থাই কলিগরা যেন বিস্ময়ে হতবাক হতো, যখন শুনতো আমি জীবনে প্রথম জব করছি এবং জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ঘরে বসে কাটিয়েছি! 

বিয়ে, ঘর-সংসার তো এসব দেশের নারীরাও করে। তবে এদের মানসিকতা আমাদের দেশের নারীদের মত একমুখী নয়। ঘর-গেরস্থালির কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় তাদের জীবন। স্টাডির পাশাপাশি এসব দেশের নারী-পুরুষ পার্টটাইম জব করতে থাকে। তারপর পুরুষের মত সব নারীই শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি করতে শুরু করে। এখানে প্রায় প্রতিটি নারীই স্বনির্ভর। পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাকে এসব দেশের নারীরা খুব অসম্মানজনক এবং লজ্জাজনক মনে করে।

ইউরোপ-আমেরিকায় একটা সুবিধা আছে। যেমন, ছোট কাজ, বড় কাজ বলতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কাজ কাজই, তা যেমনই হোক। উচ্চ শিক্ষিত, কম শিক্ষিত, মাঝারি শিক্ষিত সব রকম নারী-পুরুষই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এবং করেও তা-ই। কোনো কাজকেই এখানে ছোট করে দেখা হয় না।

আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারীর বাইরে কাজ না করার পিছনে এটাও একটা বড় কারণ। আমাদের দেশের মত অধিক জনসংখ্যার দেশে কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার পাশাপাশি প্রতিটি নারীকেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগানো জরুরি দেশের উন্নয়নের স্বার্থে। আমাদের দেশে কাজের শ্রেণি-বৈষম্য খুব বেশি এবং সাধারণ যে কোনও কাজ করাকে নারীরা সন্মানহানিকর বলে মনে করে। কখনও নারীর কাজের উপযুক্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে প্রথম যখন নারী শ্রমিকেরা গার্মেন্টস জব শুরু করল, তখন সেই নারী শ্রমিকদের খুব একটা সম্মানের চোখে দেখা হতো না। যথাযথ পারিশ্রমিকও তাদের মিলতো না। অথচ গার্মেন্টস শিল্পই বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি অনেক বেশি বাড়িয়েছে। সেই সমস্ত নারী, যাদের শিক্ষার সুযোগ মেলেনি, অন্যের বাড়িতে কাজ করা ছাড়া যাদের কোনো উপায় ছিল না, যারা একরকম সমাজের বোঝা ছিল, তারাই গার্মেন্টস শিল্পে নিজেদের শ্রম দিয়ে ‌আর্থিকভাবে নিজেরা লাভবান হয়েছে, দেশকেও লাভবান করছে।

অতএব নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোনো কাজ করা প্রতিটি নারীর একান্ত কর্তব্য, হোক তা কৃষিকাজ, শিল্পে বা ব্যবসার কাজ। পাশ্চাত্যের অনেক নারীই আছে যারা শুধু  নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার জন্যই নয়, নিজেদের মেধা ও শ্রম বিভিন্ন কাজে ব্যয় করে অসহায় মানুষদের সেবা করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। কাজে মনের তৃপ্তি খুঁজে পায়। শারিরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে বেশী সুস্থ রাখার মূলমন্ত্র হলো কাজ।

বাংলাদেশে একজন কন্যাসন্তান তার চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতিতে অনুধাবন করে যে, সে একজন নারী এবং পুরুষের চেয়ে আলাদা। এমন ধারণা নিয়েই বড় হয় সে। একজন কন্যাসন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে আত্মনির্ভরশীল করার চেয়ে কন্যাটিকে একজন উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ্ করাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে বেশিরভাগ নারীকেই পরনির্ভরশীল হয়ে এবং অন্যের গলগ্রহ হয়েই জীবন যাপন করতে হয়। বেশির ভাগ পিতা-মাতাই তাদের কন্যাসন্তানদের বয়স ষোল পার হবার পর থেকেই সৎ পাত্রে পাত্রস্থ করতে চায়। এমনও দেখা যায়, কোনো মেয়ে তার স্টাডি লাইফ শেষ করে কর্মক্ষেত্রে চলে গিয়েছে, বিবাহ করতে বিলম্ব হচ্ছে, সেই সমস্ত মেয়েদেরও সমাজের কটাক্ষ সইতে হয়।  

বিয়ে তো কোনো না কোনো সময় হবেই। কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই, আত্মনির্ভরশীল হওয়াটাই যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক, তা ভাবা হয় না। এখানেই পিছিয়ে আছি আমরা, বাংলাদেশের নারীরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৮
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ