কুয়ালালামপুর থেকে: আট বছরের বৈশাখী এবারো মাজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে টেলেন্টেড অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে। গত বছরেও এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল সে।
কুয়ালালামপুরের সবচেয়ে ব্যস্ত আর বাণিজ্যিক এলাকা বুকিত বিনতাং। আর এখানে এখন যে কোন দেশের রেস্তোরাঁকে চ্যালেঞ্জ করছে রসনা বিলাস। বাংলাদেশিদের রুচি আর আভিজাত্যের প্রকাশ এখন রসনা বিলাস। তাইতো দেশের সবার কাছেই এখন, ‘আমাদের রসনা বিলাস। ’
পেয়ার আহমেদ আকাশের দুনিয়া তার একমাত্র মেয়ে বৈশাখী। তার সঙ্গে যতক্ষন গল্প হয়, বড় একটা সময় জুড়ে থাকে বৈশাখীর গল্প। আর রসনা বিলাস তার স্বপ্নের রেস্তোরাঁ। এখানে নিজের রুচিশীলতা আর শিল্প মনের পরিচয় দেন তিনি।
এখানকার পাকিস্তানি, থাই, ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁগুলোর তুলনায় রসনা বিলাস সত্যিই সেরা। যেখানে হয় সবাই ইনডোর রেখেছে- বা আউটডোর, সেখানে আকাশ ভাই করেছেন দু’টোর সংমিশ্রন। এখানকার খোলা রেস্তোরাঁগুলোতে ধূমপান চলে জোরেসোরেই। সেখানে ইনডোরে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছেন তিনি। আর ধূমপায়ীদের জন্যে আউটডোর। যেখানে চা খেয়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়া যায় সন্ধ্যাটা।
বুকিত বিনতানের প্রথম দিনই খাওয়া হয় রসনা বিলাসে। এরপর অনেকবার খাওয়া হয়েছে রসনা বিলাসে। যথনই দেখতেন এসে খোঁজ খবর নিতেন। বসে পড়তেন আমাদের সঙ্গে, তারপর জমে উঠতো আড্ডা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে, আকাশ ভাই বরাবরের মতোই উঠালেন আরিয়া আহমেদ বৈশাখীর গল্প। বলেন, আপনাদের দোয়ায় মেয়েটা খুব মেধাবী। মাত্র ৩ বছর বয়সেই একটি চায়নিজ কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করানো হয়। ফলে বাংলার সঙ্গে মালয় আর চায়নিজ ভাষাটাও রপ্ত করে সে।
আরিয়াকে যখন মাজ ইন্টারন্যাশনালের কেজি-১ এ ভর্তি করা হয়, তখন তার বয়স চার বছর। ছোট বলে শঙ্কা ছিল শিক্ষকদের। কিন্তু তার ভাল ফলাফলের কারণে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ক্লাস-১ এ ভর্তি করানো হয়।
বুকিত বিনতাংয়ে এখন বাংলাদেশিদের প্রাণকেন্দ্র রসনা বিলাস। আর ছুটির দিনগুলোতে রসনা বিলাসের প্রাণ বৈশাখী। সে নিজেই মাতিয়ে রাখে পুরো রেস্তোরাঁ। তাকে না দেখলে বাংলাদেশিরা এসে জিজ্ঞাসা করেন, আকাশ ভাই বৈশাখী আজ আসেনি?’
সবার আদরের আর গর্বের নাম বৈশাখী।
রেস্তোরাঁয় বৃহস্পতিবার দুপুরের মেন্যু দেখালেন আকাশ ভাই। রুপচাঁদা, মাগুর, রুই, কই, তেলাপিয়া মাছ। আর যে ইলিশ, বাইন, টাকি, পাবদা আর কাচকি মাছ রয়েছে, সেটা আসে বাংলাদেশ থেকে।
দুপুরের সজ্বির মধ্যে রয়েছে- মিষ্টি কুমড়া, লাউ, আলু আর করলা ভাজি। দেশ থেকে আনা হয় পটল, কচুর লতি, কচুর ছড়া।
রয়েছে মুরগীর ফ্রাই, ঝাল ফ্রাই, কারি। এছাড়াও খাসি আর গরুর মাংস। ফ্রেশ অ্যান্ড ফ্রাইয়ের জন্যে রয়েছে গলদা চিংড়ি আর ইলিশ মাছ। রয়েছে কালিজিরা ভর্তা, সর্ষে ভর্তা, ডাল ভর্তা, শুটকি মাছের ভর্তা।
আকাশ বলেন, আমি ভাল খাবারে বিশ্বাস করি। এখানে দাম কিছু বেশি পড়লেও চাই মান যেন সেরা হয়।
সেরার পরিচয়ও পাওয়া গেলো। এক চায়নিজ ভদ্রলোক হাত দিয়ে পেটপুরে দেশি ডাল ভাত আর সব্জি খেয়ে আকাশ ভাইয়ের কাঁধে চাপড় দিয়ে গেলো।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ট্যুরিস্টরা এখন বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ নিতে আসেন রসনা বিলাসে।
চলে আসে চায়ের কাপ। বাংলাদেশি হিসেবে ভাল গরম চা পেতে হলে আপনাকে মালয়েশিয়ায় বেশ কষ্ট পেতে হবে। কারণ এখানে মগভর্তি ঠাণ্ডা চা সব দোকানে। তাই সত্যিকারের দেশি চা খেতে হলে আসতে হবে রসনা বিলাসেই। কারণ চা পাতাটাও দেশ থেকে আনান তিনি।
সহধর্মিনী ফেরদৌসী বেগম রুপা, মেয়ে বৈশাখী আর রসনা বিলাস নিয়ে বেশ খুশি আকাশ। এখানেই এখন তার পরিবার। কারণ রয়েছে ছোট তিন ভাইও।
মিষ্টি সাজানো রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, দেশ থেকে আনিয়েছেন? আকাশ বললেন, আরে না, এখানেই দেশি কারিগর দিয়ে বানানো হয়। চমচম, রসগোল্লা, লালমোহন, কালোজাম রয়েছে এখানে। আর দই, ছানা, পুডিংতো আছেই।
বিকেলে যেন বাংলাদেশের সত্যিকারের কোন রেস্তোরাঁ। গ্রীল আর কাবাবের সঙ্গে রয়েছে- পেয়াজু, মোগলাই আর সিঙ্গারা।
আমাদের জুস খেতে দিলেন আকাশ। সত্যি মালয়েশিয়ায় এতো ঘন জুস খাওয়া হয়নি আগে। বললেন, একটি আম দিয়ে একটি জুস আর কম করেও ৩টি কমলা দিয়ে এক গ্লাস কমলার জুস।
প্রথম দিনেই শুনেছিলাম। আলোস্তা সীমান্তে দালালদের হাতে বন্দি এক বাংলাদেশি। নিজের গাঁট থেকে থাইল্যান্ডের দালালদের ২ লক্ষ টাকা এবং পরে মালয়ী দালালদের ১০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্ত করে এনেছেন আব্দুল হককে। বোঝা যায়, কেন প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয় তিনি।
এখানকার রেস্তোরাঁগুলোর সাজসজ্জা মন কাড়বে না বেশি। তবে আকাশ ৫ লক্ষ টাকার পেইন্টিং ঝুলিয়েছেন রেস্তোরাঁর হোটেলে।
সন্ধ্যায় ভিড় বাড়ে। আকাশ ভাই মুচকি হেসে বলেন, আমার ভাল লাগে এখানে এসে মানুষ খাবারের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকলে। তখন নিজেকে সত্যি স্বার্থক মনে হয়।
কয়েকদিন আগে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে রসনা বিলাসে আসে বৈশাখী। কিন্তু কমিউনিটির ব্রাজিল সাপোর্টাররা প্রতিবাদ করে। তাদের অভিযোগ, আকাশ ভাই জোর করে মেয়েকে আর্জেন্টিনা শিবিরে ভিড়িয়েছে। তবে বাবাকেই কিন্তু সমর্থন মেয়ের।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৪