কোটা কিনাবালু (বোর্নিও) থেকে: ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লায় ছোট গোলপোস্টে যে ফুটবল খেলা হয়, তারই যেনো আবহ ধরা পড়লো বোর্নিও দ্বীপে। দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কোটা কিনাবালুর দাতারান মারদেকায় ভর সন্ধ্যাতেও ফুটবল নিয়ে দাপাচ্ছে একদল কিশোর মালয়ী।
পাশের সবুজ মাঠটায় পা দাবানো ঘাস। একপাশে উন্মুক্ত মঞ্চ, গ্যালারি। চারিদিকের ওয়াকওয়েতে ইভিনিং জগিংয়ে ব্যস্ত তরুণীরা। পাশের রাস্তাটা উঠে গেছে পাহাড় বেয়ে। সিগনাল হিল নামে এই পাহাড়টাই শহরের মধ্যে বন-পাহাড়ের আনিন্দ্য সুন্দর বন্ধন গড়ে গিয়েছে সাবাহ প্রদেশের রাজধানীতে। করে দিয়েছে রাজধানীর হার্টপয়েন্টে জঙ্গল ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা।
দাতারান মারদেকা বা স্বাধীনতার ময়দান থেকে বেরিয়ে আর একটু এগুতেই রাস্তার পাশে ক্লক টাওয়ার স্মৃতি বইছে ব্রিটিশ কর্তা অ্যাটকিনসনের। তারপর সারি সারি লজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিত্র বাহিনীর অন্যতম শক্তি অস্ট্রেলিয়ার সৈন্যরা এসে বানিয়েছিলো লোহার পাতের এসব মেকশিফট বিল্ডিং। এখন অবশ্য আর কোনো অস্ট্রেলিয়ানের বসবাস নেই এখানে। সেগুলোতে এখন ব্যাগপ্যাকারদের লজ। নিচে-উপরে দোতলা বেড নিয়ে গড়া এসব ডরমিটরিতে থাকা যায় অল্প পয়সায়। ভাড়া কিছুতেই ২০ থেকে ২২ রিঙ্গিতের (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা) বেশি নয়। ৮ থেকে ১০ জনের জায়গা হয়ে যায় এক রুমেই।
ব্যাগপ্যাকারদের স্বর্গ পেরিয়ে আর একটু এগুতেই রাস্তার ওপর ঝুলে থাকতে দেখা গেলো ঝাঁকড়া গাছের ঝুলগুলোকে। এই শহরের এটাই এক বিশেষ ব্যাপার। যেখানে সেখানে গাছ! মালয় উপদ্বীপের মালাক্কা প্রদেশের মতোই এখানে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি। গোটা প্রদেশের ৬১ শতাংশই বন।
ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে সুনগাই হিলের গা ঘেঁষে আর একটু এগুতেই জবা ফুলের ফোয়ারা। বান্দরবানের পাহাড়ে এমন রক্তজবা ঢের ফুটে থাকতে দেখা যায়।
এই প্রথম ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়লো ব্যস্ত চার রাস্তার মোড়ে। জেসেলটন পয়েন্টের প্রবেশ মুখ কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে একটু আগের বৃষ্টিতে। ভারতবর্ষের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ব্রিটিশ নর্থ বোর্নিও চারটার্ড কোম্পানি যে ১৮৮১ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এদেশ শাসন করেছে তাই স্মৃতিচিহ্ন চীন সাগরের ওপরে গড়া ওই জেসেলটন জেটি। ওই কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নাকি বেজায় দাপুটে ছিলেন জেসেলটন। এই কোটা কিনাবালু শহরের নাম তো একসময় জেসেলটনই ছিলো।
জেটি ছাড়িয়ে খানিকটা এগুতেই সুরিয়া সাবাহ। সম্ভবত কোটা কিনাবালুর সবচেয়ে বড় শপিং মল এটাই। সামনে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে মালয় আদলের গোটা চার ভাস্কর্য। এখানে একের পর এক শপিং মল আর মল। স্থানীয় পণ্যের পসরা নিয়ে গড়া সুপার শপও রয়েছে অনেকগুলো। এসব শপিং মল আর সুপার শপ তো বটেই, রাস্তাতেও রঙিন আলোর মেলা।
হাজারো প্রজাতির মাছের সমাহারে জমজমাট সিফুড বাজার আর ওয়াটার ফ্রন্টকে পাশ কাটাতেই চোখ আটকে গেলো হালাল লেখা রেস্তোরাঁয়। অনেকক্ষণ ধরেই পেটের ভেতর ছুঁচো ডন দিচ্ছে। খাবার জন্য তাই হালাল দোকানে ঢুঁ মারতেই ধাক্কা খেতে হলো খাদ্য খাওয়ার আগেই। এখানে হালাল লেখা রেস্তোরাঁ সাজিয়ে বসেছে আসলে এক তামিল।
খানিকক্ষণ আলাপ জুড়তেই কিচেন থেকে এক বাংলাভাষী বাবুর্চি ধরে নিয়ে এলো তামিল ম্যানেজার। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে খুশি হচ্ছিলাম কেবল। কিন্তু খুশির জোয়ার শুরুর আগেই শুরু হলো ভাটার টান। বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সুরেশ দাশ।
যা হোক, তবু তো কারো সঙ্গে বাংলায় কথা বলা গেলো দু’দিন পর। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সমভাষীকে খুব একটা সময় দিলো না তামিল ম্যানেজার। টেবিলে খাবার গুছিয়ে কি এক কাজের ছুতোয় সুরেশকে পাঠিয়ে দিলো কিচেনে।
গরুর মিষ্টি কলিজা, আধাকাঁচা বেগুন, প্রায় কাঁচা করলা, ডাল আর টলটলে স্যুপ কোনোমতে গলঃধকরণ করে আর একটু এগুতেই হাতের বাঁয়ে সেন্টার পার্ক। এক পাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত চারটার্ড কোম্পানির ১৩ সৈন্যের স্মৃতিফলক।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা বিতাড়িত হওয়ার পর জাপানি আর্মির হাতে বধ হওয়া অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের সম্মানে একটা স্মৃতিফলকও আছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিফলকের পেছনে।
পার্কের ভেতরের পরিবেশ বেশ ছিমছাম। গাছে গাছে নাম জানা- না জানা স্থানীয় ফল ঝুলছে। সাজানো গোছানো পার্কটার একপাশে বেশ কিছু বাস কাউন্টার। অনেকটা গাবতলী টার্মিনালের টিকিট কাউন্টারের মতো। এ দ্বীপের একমাত্র মালয় টেরিটোরি লাবুয়ান আর মালয়েশিয়ার বৃহত্তম রাজ্য সারাওয়াক ছাড়াও সুলতান শাসিত ব্রুনাইয়ের এক্সপ্রেস বাস ছাড়ে এখান থেকে।
পার্ক পেরিয়ে কামপুং আয়ারকে বাঁয়ে রেখে খানিকটা এগুতেই সেন্টার পয়েন্ট। ডানে পড়ে রইলো তাজা সিফুডের খোলা বাজার।
শহরের বুক চিরে বয়ে চলা খালটার পাড় বাঁধানো হলেও ঢাকা শহরের খোলা নর্দ্দমার মতোই দুর্গন্ধ তাতে। এই একটা বিষয়ই যেনো কয়েক হাজার মাইল দূর থেকেও একটানে নিয়ে গেলো ঢাকা শহরে।
এরই মধ্যে অট্টালিকার সংখ্যা কমে গেছে। বেড়ে গেছে উন্মুক্ত চত্বর। এক সময় মূল শহরটা সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে এলো। মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যের রাজধানী পায়ে হেঁটে চক্কর দেওয়া হয়ে গেলো মাত্র ৭ ঘণ্টায়!
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
জেডএম/এটি