ইনানাম (বোর্নিও) থেকে: পাথরের ওপর পানি গড়ানোর বিকট শব্দে এমনিতেই কানে তালা লাগার যোগাড়। তারওপর জাপানি বুড়োটা ঝুলন্ত ব্রিজটাতে রীতিমতো দোল খাওয়া শুরু করলো।
একই ছাদের নিচে মাঝখানে একটা হলঘরের মতো। তাকে ঘিরে চারিদিকে ছোট ছোট ঘর। একই ছাদের নিচে দোতলা শেপও দেওয়া হয়েছে। এক প্লাটফর্মে। তবু একের ঘরের মেঝে একের লেভেলে। বাংলাদেশের ট্রাইবাল হাউসগুলোর মতো সমান নয়। পাটাতনে উঠেই বোঝা গেলো প্রথম খুপরিটা ভাঁড়ার ঘর। বাঁশের চৌকির ওপরে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ঝুড়ি ছাড়াও আস্ত কদুসহ বিভিন্ন কিসিমের সবজি সাজিয়ে রাখা। ডানে ঘুরতেই মাঝের হলঘরটার একপাশে কলাপাতায় মোড়া বিভিন্ন সাইজের কলসি। ওগুলোতে খাবার সংরক্ষণ করে এরা।
এগুলোর মাথার উপর দিয়ে উপরে উঠে গেছে একটা কাঠের সিঁড়ি। দু’পাশে দু’টো ঘরে কৃষিকাজ আর গৃহস্থালির সরঞ্জাম। ওপর থেকে বাচ্চা রাখার দোলনা ঝুলছে। বিপরীতে ঘর আলো করে বসে আছে এক দুসুন তরুণী। তার সামনে বাঁশের ছোট ছোট চোঙ্গায় চালের সরাব। পাশে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সারি সারি পাত্র। উত্তর বোর্নিওর এই আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় আর এক আদিবাসী গোষ্ঠী কাদাজানদের অনেক সাযুজ্য থাকায় উভয় গোষ্ঠীকে এক সঙ্গে কাদাজান দুসুন নামেও ডাকা হয়। বনে-জঙ্গলে থাকলেও এ অঞ্চলের বৃহত্তম গোষ্ঠীর মেয়েদের গায়ের রঙ দুধে আলতার চেয়েও মোলায়েম। তাদের রূপের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এ মেয়েটাকে দেখে তার প্রমাণও মিললো। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে বুঝিবা অরণ্যের রাণীই বসে আছে সামনে। এরা যে কতোটা অতিথিপরায়ণ তার প্রমাণ দিতেই বুঝি রাইস ওয়াইনের একটা বাঁশপাত্র এগিয়ে ধরলো তরুণী। এরা পরিশ্রমী। পছন্দ করে পাহাড় বা উঁচু ভূমিতে থাকতে। উত্তর বোর্নিওর বৃহত্তম এই জনগোষ্ঠী অতিথির জন্য নিবেদিত প্রাণ। সামনে বাড়িয়ে ধরা পেয়ালাটা তাই নিতে হলো অগত্যা। বাংলাদেশের বান্দরবানের মতোই কিছুটা, তবে কটূ গন্ধ একদমই নেই। দুসুন সুন্দরীর কাছে বিদায় নিয়ে উল্টোদিকে বেরিয়ে আসতেই সাজানো গোছানো রসুই ঘর। মাঝখানে চুল্লি, তাকে ঘিরে থরে থরে র্যাক। সেগুলোতে ভূট্টা আর লাউসহ চেনা-অচেনা সব সবজি সাজিয়ে রাখা। জঙ্গলে থেকেও কতোটা সুশৃ্ঙ্খল জীবন যাপন করছে এরা!
মাঝের ঘরটাতে থাকার ব্যবস্থা বাচ্চাদের। একপাশে দাদা, আর এক পাশে বাবার ঘর। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপরের খুপরিটায়। আর কতোটা সুবিন্যস্থ হতে হবে তবে?রসুই ঘরের পাশ দিয়ে নিচে নামতেই বাঁশের কাউন্টারে মুরগির টুকরা, চাল, পেঁয়াজ আর লবণ সাজিয়ে রাখা। সব কলাপাতায় মুড়ে বাঁশের ভেতরে দিয়ে কয়লার আগুনে মাত্র পনেরো মিনিটেই খাবারটা রান্না করে ফেললো আর এক সুন্দরী তরুণী। চামচের আগায় বাড়িয়ে দুসুন ভাষায় কি বললো কে জানে। নিশ্চয়ই খেতে বলছে।
চামচটা নিয়ে মুখে ঢালতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। আহ! কি অপূর্ব স্বাদ! যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো সম্ভব নয়। বেরিয়ে যাওয়ার পথে এবার এক দুসুন তরুণের আহবান। আগেরটা তো খেয়েছো, এবার আমাদের আর একটা রাইস ওয়াইন চেখে দেখো।
এমন আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না। গেলো না। আসলেই তো জুড়ি নেই এদের অতিথিপরায়ণতার। পাহাড়-জঙ্গলের মানুষ হলেও সহিংসতা বিমুখ এরা। নিজেদের ভাষায় কথা বলে। চাষাবাদ করে। বিশেষ এক ধরনের গাছের রস দিয়ে মাছ ধরে খাল-নদীতে। সর্বপ্রাণবাদী হলেও এখন মূলত খ্রিস্টান আর মুসলিম ধর্মে নাম লিখিয়েছে অধিকাংশ দুসুন। পাশাপাশি চালু রেখেছে নিজেদের সামাজিক অনুশীলনটাও। তবে মূলধারায় মিশে যাওয়া দুসুনের সংখ্যা কিন্তু দিন দিনই বাড়ছে।
আরও পড়ুন
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৬
এমজেএফ/জেডএম/