জোহর বাহরু (মালয়েশিয়া) থেকে: ফ্লাইওভারটার নিচে জমে উঠেছে শ্রমিকদের কেনাকাটা। একের পর এক শ্রমিক এসে ওজন দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে চাল, মাছ, মুরগি, সবজি, ফল।
ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে সিঙ্গাপুর কজওয়ের দিকে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ির পর গাড়ি। নিচের পরিত্যক্ত রাস্তাটাতেও তার কম্পন বেশ জোরালো। আগে এই রাস্তাটাই ছিলো সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথ। সম্প্রতি এই ফ্লাইওভারটি হওয়ার পর স্বভাবতই এ রাস্তাটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এখন সেটাতেই নির্মাণ শ্রমিকদের জমজমাট বিকিকিনি।
ওজন দিয়ে নাশপাতি, আঙুর আর কলা কিনলেন কুমিল্লার আব্দুল মতিন। বরিশালের ফারুক হোসেন ও শরীয়তপুরের আলমাস বেপারী কিনলেন চাল আর মাছ। প্রতি মাসে ৪০০ রিঙ্গিতেরও ওপর খাবার খরচ এদের। কষ্টের কাজ বলে ভালো খেয়ে শরীর ঠিক রাখতে হয়। এদেরই শ্রমে আর ঘামে জোহর বা সিঙ্গাপুর প্রণালীর এ পাশে মাথা তুলছে আরো অনেক বহুতল ভবন। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এসে এদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে আয় করা টাকায় দেশে লেখাপড়া চলছে ভাইয়ের, বিয়ে হচ্ছে বোনের, অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসা চলছে এদের টাকায়, দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের ব্যবসাও।
দিনমান খাটুনির পর তাই মতিন, ফারুক, আলমাসের চোখে স্বস্তির ছাপ। দেশে টাকা পাঠানোটাও এখানে অনেক সহজ এখন। কুয়ালালামপুর থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে সিঙ্গাপুর সীমান্তের এই মালয়েশীয় শহরে বুথ বসিয়েছে বাংলাদেশের অগ্রণী ব্যাংক। প্রবাসীদের টাকা দেশে পাঠানোই মূল কাজ তাদের।
এখান থেকে অনায়াসে এই ব্যাংকের মাধ্যমে এক হাজার রিঙ্গিত পাঠানো যায় ১০ রিঙ্গিত খরচে, ২ হাজার রিঙ্গিতের খরচ পড়ে ১৫ রিঙ্গিত, আর ৫ হাজারে ২০ রিঙ্গিত। মালয়েশিয়ার আর সব রাজ্যের তুলনায় অবশ্য এই জোহর রাজ্যের শ্রমিকদের অবস্থা ভালো বলে তাদের ভেতর এক ধরনের পরিতৃপ্তিও দেখা গেলো। ১০ ঘণ্টা ডিউটিতে ৯০ রিঙ্গিত পর্যন্ত আয় আসে একেকজনের। ৮ ঘণ্টা ডিউটির সঙ্গে ২ ঘণ্টা ওভারটাইমে একজন নির্মাণ শ্রমিকের আয় দাঁড়ায় বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৫ হাজারের মতো। এই আয়টাই পরিশ্রমের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয় তাদের।
বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন, ভারত আর নেপালের শ্রমিক আছে এখানে। তবে ৯০ শতাংশ শ্রমিকই বাংলাদেশি। পেছনে তাদের সারি সারি টিনের দ্বিতল ঘর। অনেকটা পূর্ব মালয়েশিয়ার আদিবাসী লংহাউসের মতো।
শোওয়ার ব্যবস্থা ঢালাও। তবে আয়োজনটা নির্মাণ কোম্পানিরই। থাকার জন্য ভাড়া দিতে হয় না এদের। এখানকার শ্রমিকদের তাই খাবার খরচটাই মূল খরচ। এরা তাই প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দেশে পাঠানোর ক্ষমতা রাখেন। পাশেই হোটেল। রান্না না করতে চাইলে সস্তায় খাবার মেলে সেখানেও। বাংলাদেশের বাবুর্চির হাতে বানানো সিঙ্গাড়া আর জিলাপিও বিকোচ্ছে সেখানে।
একখানে কংক্রিটের কাঠামোতো দু’সারি পানির কল। কাজ শেষে ফিরে শ্রমিকরা গোসল করছে সেখানে। এখানে ওখানে দলবেঁধে আড্ডা দিয়ে অবসর কাটাচ্ছেন শ্রমিকরা। একেক স্থানে একেক দেশের শ্রমিক। মিশ্র আড্ডা একটাও চোখে পড়লো না। তবে পরস্পরের সঙ্গে শুছেচ্ছা বিনিময়ে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৬
এইচএ/জেডএম/
আরও পড়ুন
** লাখ টাকায় কোটিপতি হোন আপনিও
** বিনা ভাড়ায় ঘুরুন কুয়ালালামপুরে
** শিকারি কুমিরের সঙ্গে কোলাকুলি
**আকাশের হেলান দিয়ে মসজিদ ভাসে ওই
** প্রলয় নৃত্যে হতবাক দর্শক
**নরমুণ্ডু শিকারী মুরুত গাঁওয়ে
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে