জোহার বাহরু (জোহর) ঘুরে: জোহর বাহরু সেন্ট্রাল এর কাছে মরণ জ্যাম বেঁধেছে। ৪ কিলোমিটার দূরের আন্তনগর বাস টার্মিনাল থেকে দ্রুত এখানে এসে এসি বাসটা আর পিঁপড়ের গতিতেও এগুতে পারছে না।
মাথার ওপর দিয়ে ফ্লাইওভারটা একটু এগিয়ে সিঙ্গাপুর কজওয়েতে নেমেছে। সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়াকে ভাগ করে রাখা জোহর প্রণালীর পাড়ে উঁচু টিনের বেড়া। খুব বেশি দূর তাই দৃষ্টিও চলে না এখানে।
বেশ কিছু সময় বাসের ভেতর নিশ্চল বসে থাকার পর যাত্রীরা নেমে যেতে শুরু করলো। এই জোহর মালয়েশিয়ার উন্নত রাজ্যগুলোর একটি হলেও রাজধানী জোহর বাহরুর এ অংশটাতে গিজগিজে ভিড়। তিনতলার ওপরে সিঙ্গাপুরমুখী মালয়েশীয় ইমিগ্রেশন লবিটাও মানুষে ঠাসাঠাসি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড।
চারপাশের ঝকঝকে বহুতল ভবনগুলোতে জোহর শব্দের উৎপত্তিগত অর্থের প্রতিফলন। কেননা প্রাচুর্যময় কোনো কিছুর সঙ্গে মিল রেখে স্থানের নামকরণের চল মালয় উপদ্বীপে সহজাত। এখানকার বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জোহর শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ জাওহার থেকে, যার অর্থ রত্ন।
আজদাহা ভবনগুলোকে পাশ কাটিয়ে বেশ ক’টা বাঁক ঘুরে এই রত্নভূমির দক্ষিণ মাথায় এসেই চক্ষু চড়কগাছ! কজওয়েতে দু’ভাগ হয়ে গেছে জোহর প্রণালী। মালাক্কা প্রণালীর দিক থেকে আসা চ্যানেলটা যেনো কজওয়েতে মাথা খুঁটছে দক্ষিণ চীন সাগরের দিক থেকে আসা চ্যানেলটার সঙ্গে মিলিত হওয়ার অতীব আগ্রহে। প্রণালী রূপ নিয়েছে বদ্ধ পুকুরে। নিস্তরঙ্গ পানিতে বাতাসের কাঁপনও নেই।
কজওয়েতেও জ্যামে বসে রোদে পুড়ছে ছোট-বড় অগণিত গাড়ি। কজওয়ের মাঝখান দিয়ে একটা ট্রেন ছুটে গেলো সিঙ্গাপুরের দিকে। গাড়ির জ্যামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকায় মাত্র মিনিট খানেকের মধ্যেই থাইল্যান্ড থেকে আসা ট্রেনটা হারিয়ে গেলো প্রণালীর ওপাড়ে, সিঙ্গাপুরের উঁচু উঁচু দালানের আড়ালে।
মাত্র ১০৩৮ মিটার প্রশস্ত প্রণালীর মাঝ বরাবার দু’দেশের জলসীমা। ওপাশের জলসীমায় স্রোতহীন পানিতে স্থির সিঙ্গাপুরের টহল বোট। এপাশে কোনো বোট নেই বটে, তবে কজওয়ের দিকটা আটকানো লোহার জালে। আর পাড় জুড়ে ক্রংক্রিটের দেওয়াল। তার নিচে ইট-সিমেন্টের বড় বড় বোল্ডার ঢেকে দিয়েছে প্রণালীর পাড়।
বাংলাদেশের মতো এখানেও দর্শনার্থীদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক বোতল আর কোমল পানীয়ের ক্যানগুলো দাঁত ভেংচাচ্ছে যেনো। পাড়ের কংক্রিটের প্রশস্ত দেওয়ালে বসে আড্ডা জমিয়েছে বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিকদের একটি গ্রুপ। সবার বাড়ি যশোরের শার্শা। একজন কেবল মাগুরার যুবক আছে তাদের আড্ডায়। তাকে ঘিরেই চলছে শার্শা গ্রুপের খুনসুটি। কজওয়ে ঘেঁষা অপ্রশস্ত জায়গাটায় ফুটবলে মেতেছে যশোরেরই চৌগাছা গ্রুপ।
ওদের জানার কথা নয়, এই কজওয়ের দ্বন্দ্বেই ১৯৬৫ সালে মালয় ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয় সিঙ্গাপুরকে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ফেডারেশন ভুক্ত মালয় রাজ্যগুলোর যাতাযাত তখন হতো মালাক্কা প্রণালী হয়ে জলপথে পোর্ট ডিকসন থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশ স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক সদর দপ্তর তখন সিঙ্গাপুরে। ১৯০৩ সালে তাই রেল ফেরিও চালু হয় জোহর বাহরু আর সিঙ্গাপুরের মধ্যবর্তী প্রণালীর পানিতে।
কিন্তু ১৯১৯ সালে ওই প্রণালীতে কজওয়ে নির্মাণ শুরু করে দেয় সিঙ্গাপুর। ১৯২৩ সাল নাগাদ কজওয়ের নির্মাণ শেষ হলে দুভাগ হয়ে যায় প্রণালীর পানি। স্বাস্থ্যগত হুমকি তৈরি হয় জোহরের জন্য। তাই সেতু গড়ে কজওয়ে সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া। যাতে খোলা পানির প্রাকৃতিক স্রোতে জাহাজ চলতে পারে জোহরের পুরনো বন্দর পাসির গুদাং থেকে নতুন বন্দর গেলাং পাতাহ পর্যন্ত। কিন্তু সে প্রস্তাব উড়িয়ে দেয় একরোখা সিঙ্গাপুর।
তবুও হাল ছাড়ে না মালয়েশিয়া। এবার অর্ধসেতুর পরিকল্পনা সামনে আনে তারা। পরিবর্তিত প্রস্তাব দেয়, জল সমতল থেকে ২৫ মিটার উঁচু হয়ে উভয় ভূখণ্ড থেকে সেতু আসবে প্রণালীর মাঝ বরাবর। মাঝামাঝিতে সাজানো হবে নিচু কজওয়ে। রেলওয়ের জন্য থাকবে সুইং সেতু। এতেও সাড়া না পেয়ে সিঙ্গাপুরের তোয়াক্কা না করেই দেওয়া হয় সেতু এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা। কিন্তু অব্যাহত বিরোধিকার মুখে কতোদূরইবা আর কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়!
তাই থেমে যায় অর্ধসেতুর বাস্তবায়ন। আর সিঙ্গাপুরকে বের করে দেওয়া হয় মালয় ফেডারেশন থেকে। তারপর থেকে সিঙ্গাপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে যায়। প্রণালীকে ভাগ করে থেকে যায় কজওয়েটা। আর এ পাশের জোহর তো এশীয় মূল-ভূ-খণ্ডের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত আগে থেকেই। জোহর নাম ধারণের আগে উজোং তানাহ বা ভূমির শেষপ্রান্ত নামেই পরিচিতি ছিলো এ এলাকার। এশিয়ার যে কোনো প্রান্ত থেকে এখানটাতে আসা যায় কোনো সাগর পাড়ি না দিয়েই।
আরও পড়ুন
** বাংলাদেশিদের হাতেই জোহর বাহরুর পাইকারি বাজার
**‘ভালো আছে জোহর বাহরুর বাংলাদেশ’
** লাখ টাকায় কোটিপতি হোন আপনিও
** বিনা ভাড়ায় ঘুরুন কুয়ালালামপুরে
** শিকারি কুমিরের সঙ্গে কোলাকুলি
**আকাশের হেলান দিয়ে মসজিদ ভাসে ওই
** প্রলয় নৃত্যে হতবাক দর্শক
**নরমুণ্ডু শিকারী মুরুত গাঁওয়ে
** মুসলিম বাজাউরাই বিত্তশালী বোর্নিওতে
**কলসির ভেতর লুনদায়েহ কবর
**লঙহাউজের রুঙ্গুস রাণী
**বনের ভেতর দুসুন গাঁও
** এক বাজারেই পুরো বোর্নিও
**বোর্নিওতে কী পেতে পারে বাংলাদেশ
** সুলু সাগর তীরের হেরিটেজ ট্রেইলে
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৬
এসআরএস/এমজেএফ/জেডএম/