হীরে-জহরতের গহনার সেটের তুলনায় আসা দেশটির নাম মালয়েশিয়া। এই দেশকে এশিয়ার ‘ইউরোপ’ বলা হলেও মাঝরাত্তিরে আকাশ থেকে এক পলক দেখলে তারও চেয়ে বেশি কিছুই মনে হবে।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে উড্ডয়নের পরই চোখ গেলো জানালা দিয়ে বাইরে। আকাশ থেকে ঢাকাকে একটা সময় জোনাকপোকার রাজ্য মনে হচ্ছিলো। মাঝেমধ্যে মহাসড়কে গাড়ির চাপ আর সীমান্তের কড়া-বাতি নির্দেশ করছিল ফ্লাইট দক্ষিণ-পূর্ব পাশ হয়ে এগোচ্ছে দক্ষিণ দক্ষিণের মালয়েশিয়ার দিকে। মাঝে আলোর খেলায় চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত অনুমান করা গেলেও এরপর মেঘের দলের ছোটাছুটি সব কিছু ঝাপসা করে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে নজরে এসেছে সাগরকূলে নোঙ্গরে থাকা কোনো বড় জাহাজের আলো।
প্রায় চার ঘণ্টার লম্বা পথ বলে ঘুম নেমে আসছিলো চোখে। আপ্যায়নকালে চোখ খুলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের ভূখণ্ডটা অনুমান করার চেষ্টা করলেও রাতের অন্ধকারে মাঝেমধ্যে হালকা সাদা মেঘের দৌড়ই দেখা গেলো।
সাড়ে ৩ ঘণ্টারও কিছু বেশি সময় পর ঘুম ভাঙলে জানালা দিয়ে ফের চোখ গেলো বাইরে। এবার আর চোখ ফেরে না। নিচে কি কেউ গহনার দোকান সাজিয়ে বসেছে? মনে পড়ে অগ্রজ যাত্রীদের বিস্ময়মাখা মন্তব্যসব, ‘সাজানো-গোছানো মালয়েশিয়া অবাক করে ইউরোপবাসীদেরও’।
তবে কি এটা মালয়েশিয়ার ভূ-খণ্ড? একজন কেবিন ক্রু নিশ্চিত করলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা এখন মালয়েশিয়ার আকাশে, অল্প সময় লাগবে অবতরণ করতে’। আগের-পিছের সহযাত্রীরাও জানালার দিকে গলা বাড়িয়ে কেবল ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন। এটা কি সত্যিই কোনো দেশ? ঢাকার আকাশে যখন প্লেন উড়ছিলো, তখন নিচে কেবল বিক্ষিপ্ত বাতি বোঝা যাচ্ছিলো। গিঞ্জি আলোর ঝলমল খেলা সেটাকে শহরের পরিচয় দিলেও মালয়েশিয়ার ভূখণ্ডে কখনো চতুর্ভুজ আকৃতির, কখনো সমান সারিবদ্ধ বাতির ঝিকিমিকি খেলা বোঝাচ্ছিলো পরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিকল্পিত অবকাঠামোকে, সঙ্গে জানান দিচ্ছিলো এর সৌন্দর্যের নৈসর্গিক মাত্রা।
রাতের আকাশ ভেদ করে দিনের আলোকে ডেকে ফ্লাইট নামলো কুয়ালালামপুরে। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করার পর যাত্রা আবাসস্থল বুকিত বিনতাংয়ে। শেষ রাতে মালয়েশিয়ার আকাশ যে বিস্ময় দেখালো, দিনের প্রথম প্রহরে সেই বিস্ময়ই যেন প্রতিষ্ঠিত করলো দেশটির ‘ছবির মতোন সুন্দর’ অবকাঠামো। পিচঢালা নিখুঁত সড়ক বেয়ে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে গাড়ি ছুটতে থাকলো আবাস হোটেলের দিকে। চোখ একবার যাচ্ছিলো সামনের সুপ্রশস্ত এবং আঁকা-বাকা পাহাড়ি সড়কের দিকে। একবার যাচ্ছিলো আশপাশের পামের বাগানে। ফের চলে যাচ্ছিলো কাছে-দূরে গড়ে ওঠা আকাশছোঁয়া সারি সারি অট্টালিকার দিকে। মূল শহর থেকে বাইরে গড়ে তোলা বিমানবন্দর থেকে বুকিত বিনতাংয়ে পৌঁছাতে সময় লাগলো ঘণ্টাখানেকের মতো। লেন, রুট বদল এমনকি পাতাল সড়ক দিয়ে গাড়ি ছুটলেও শোনা গেলো না একবারের জন্যও হর্ন।
আকাশ থেকে পরিপাটি ও গোছানো মালয়েশিয়াকে দেখে যতটুকুন ঈর্ষা জেগেছিলো, বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখা মালয়েশিয়া সে ঈর্ষা বাড়িয়ে দিলো কয়েকগুণ। অনুমানটা সহজেই করা যায় যে, কেবল অর্থের জোরে নয়, হৃদয়গভীর ভালোবাসায় মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে মাঠ পর্যায়ের শ্রমিক শ্রেণী, সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়ই আজকের এই ‘বিস্ময় জাগানিয়া’ মালয়েশিয়া। ঈর্ষা জাগে ফের, মাতৃভূমিকে গড়ে তুলতে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?’
হুসাইন আজাদ, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৭, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৭
এইচএ/