বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রমজানের ফজিলত ও তাৎপর্য নিয়ে এভাবেই বলছিলেন ফেনীর প্রধান মসজিদ বড় জামে মসজিদের খতিব ও ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ।
কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ইসলামী আইনে উদারতা ও সম্প্রীতির ওপর এমফিলে অধ্যয়নরত এ আলেম মসজিদটিতে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরে।
বাংলানিউজের সঙ্গে তার এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ওঠে আসে রমজানের নানা ফজিলতের কথা।
মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, দুনিয়ার বাস্তব জীবনে যে কোনো পেশায় আগ্রহী ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করার পর পেশায় নিয়োজিত হয়। পেশায় নিযুক্তির পর অভিজ্ঞতা ধরে রাখার জন্য মাঝে মধ্যে কিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হয়। এসব প্রশিক্ষণে পাওয়া অভিজ্ঞতা পেশাগত জীবনে কাজে লাগাতে হয়। ঠিক তেমনই মাহে রমজান ১২ মাসের মধ্যে এক মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স।
‘এ কোর্স সমাপ্ত করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে। আর অর্জিত দক্ষতা হবে আল্লাহর বান্দা হিসেবে দায়িত্ব পালনের দক্ষতা। এ দক্ষতা দ্বারা মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করাই হচ্ছে মানুষের কাজ। ’
তিনি বলেন, সিয়াম আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে এক মহান উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহর অমীয় বাণী বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এরশাদ হয়েছে, তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনা করলে ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় জন্মে আর আল্লাহর ভয় জন্মালে মানুষ সৎ-স্বভাবের অধিকারী হয়।
এছাড়া লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, চাটুকারিতা, মজুদদারিতা, ধন-সম্পদের স্পৃহা, যশ বা খ্যাতিমান হবার স্পৃহা, মিথ্যা অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি ইত্যাদি সমাজ ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপসহ সব মানবীয় দুর্বলতা দূরীভূত হয়।
পক্ষান্তরে, সিয়ামের বদৌলতে মানুষের অন্তরে রহমতের ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। তখন মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সিয়াম পালনকারীদের মধ্যে লজ্জাশীলতা, আত্মসংযম, সত্যবাদিতা, সরলতা, ভদ্রতা; সাহস, সন্তুষ্টি, মানবপ্রেমসহ সৎগুণাবলীসমূহ সতেজ হয়।
সিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাপারে সাইফুল্লাহ বলেন, রমজানের সিয়াম সাধনা হলো সত্যিকার অর্থে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের সাধনা। এতে লোক দেখানোর অহেতুক অভিলাষ থাকে না। এক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য হয়, সিয়াম পালনকারীর এক টানা সিয়াম সাধনা।
আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, রোজা আমারই জন্যে, আর আমিই এর প্রতিদান দেবো। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভই হবে এর সত্যিকার প্রতিদান, যা রোজাদার লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে রোজাদার ব্যক্তিদের বেহেশতের রাইয়্যান দরজা দিয়ে প্রবেশ করাবেন।
তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ করতে পারেনি তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে রোজা রাখায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেছেন, এমন কিছু রোজাদার রয়েছে, যাদের রোযা দ্বারা শুধু পিপাসায় লাভ হয়। সুতরাং রমজানের সিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুমিনদের জীবন থেকে পাপ দূরীভূত করে তাকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করা। মুমিনদের গুনাহ মাফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
‘সিয়াম পাপের পথে একটি প্রচণ্ড বাঁধার সৃষ্টি করে। একজন সিয়াম পাপের পথ থেকে সহজে দূরে থাকতে পারে। এজন্য সিয়াম হাদিস শরীফে ঢাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ’
সিয়ামের মাধ্যমে আত্মার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার মধ্যে সংযম অবলম্বনের শক্তি নেই, তার মধ্যে কোনো বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ববোধ সৃষ্টি হতে পারে না। ব্যক্তিত্বের যথার্থ বিকাশের জন্য নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্মত হতে হবে।
‘সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণাবলী সৃষ্টি হয়। একজন মানুষের জীবনের সার্বিক সফলতা ও বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিত্ব গঠনেও সংযমের গুরুত্ব অপরিসীম। ’
মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, রমজান মানুষকে ধৈর্য ধারণ করতে শেখায়। সবর (ধৈর্য) হচ্ছে মুমিন জীবনের এক অপরিহার্য গুণ। সিয়াম প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের মধ্যে সবরের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রচণ্ড ক্ষুধা, খাদ্যও রয়েছে। এমতাবস্থায় না খেয়ে থাকার জন্য প্রচণ্ড ধৈর্যের প্রয়োজন। ভীষণ তৃষ্ণা লেগেছে, ঠাণ্ডা পানীয় হাতের কাছেই; কিন্তু এখন পান করা যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
প্রচণ্ড সবরের গুণ না থাকলে কী তা সম্ভব? সারাদিন পানাহার না করে সন্ধ্যাবেলা পানাহার করার পর স্বাভাবিকভাবে ক্লান্তিতে দেহ-মন শিথিল হয়ে আসে। মন চায় একটু বিশ্রাম ও আরাম। কিন্তু না আরাম নয়; যেতে হবে দীর্ঘ নামাজে। তারাবির জন্য ছুটতে হবে। তারাবির পর ঘুম। কিন্তু ফজর পর্যন্ত আরামে ঘুমানো যাবে না, উঠতে হবে ভোর রাতে সেহেরি খাওয়ার জন্য। সারারাত যেন ভালো ঘুম হয় না। কিন্তু তাই বলে সারাদিন ঘুমিয়ে অলসভাবে সময় কাটানোর সুযোগ নেই। দিনের বেলায় সব দায়িত্বই পালন করতে হয়। এতে অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে কষ্ট হয় বেশি। এভাবে প্রতিদিনের কষ্ট ও ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা রোজাদারের মধ্যে সৃষ্টি করে প্রচণ্ড ধৈর্য ও সবরের গুণ।
সিয়াম শারীরিক সুস্থতা বিধানের বিষয়ে এই আলেম বলেন, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ঈমানি গুণাবলী সৃষ্টি করা হলো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এসব গুণাবলী অর্জনের পাশাপাশি অন্যান্য ফায়দা হিসেবে দৈহিক কল্যাণের কাছে একদম উপেক্ষা করা যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, শরীরের পরিপাকযন্ত্রেরও মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।
‘অব্যাহত ভোগ শরীরকে ক্লান্ত ও একঘেয়ে করে দিতে পারে। তাই মাঝে মাঝে উপবাস স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর। তাছাড়া দেহকে ক্ষুৎপিপাসার মোকাবেলায় কার্যক্ষম ও সচল রাখারও অনুশীলন প্রয়োজন। মনের মধ্যে ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস একজন সংগ্রামী মানুষের জীবনে একান্তই অপরিহার্য। ’
তিনি বলেন, মানুষের উন্নতি ও বিকাশের জন্য উত্তম পরিবেশ প্রয়োজন। পরিবেশ ভালো না হলে, সুন্দর না হলে মানুষের জীবনকে ভালো ও সুন্দুরভাবে গড়ে তোলা যায় না। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য পবিত্র ও সুন্দর পরিবেশ নিয়ে আসে। পূণ্যময় জীবন-যাপনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় রমজানে। সহানুভুতি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে সিয়াম। রমজানে মানুষ পূণ্যের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবেশ পায়। পাপ থেকে দূরে থাকার শক্তি পায়। সর্বত্র যেন এক শান্ত, পুতঃপবিত্রতা বিরাজ করে। গোটা পরিবেশ যেন পূণ্যের আবেশে আবিষ্ট হয়ে উঠে। গোটা মাসটি যেন রহমতের ফল্গুধারায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে ইঙ্গিত দিয়েই মহানবী (স.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় অন্য বর্ণনায় রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। ’
সিয়ামের মাধ্যমে সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের ব্যাপারে তিনি বলেন, মানব সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য পরস্পরর সহানুভুতি ও সহমর্মিতা একান্ত প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যদি সহমর্মিতা না থাকে, তাহলে সে সমাজ সুখ-সমৃদ্ধ হতে পারে না। বিশেষ করে সমাজের স্বচ্ছল শ্রেণী যদি ওই সমাজের অস্বচ্ছল এক কথায় সমাজ উন্নয়নের জন্য, সামাজিক সুষম বিকাশের জন্য, মানবজাতির প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য পরস্পর সহানুভুতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টি একান্ত কার্যকর।
‘মাহে রমজানের সিয়াম একটি সমষ্টিগত ইবাদত। এ মাসটি আসা মাত্র সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে এক অনাবিল প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। স্বতঃস্ফুর্তভাবেই এমন এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়, যাতে সিয়াম সাধনা সবার জন্য অনায়াসে সাধ্য ও সহজবোধ হয়,’ বলেন এই আলেম।
মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, মুমিনের মন আপনা থেকেই যেন বিগলিত হয়ে ওঠে। প্রতিযোগিতা শুরু হয় ইবাদাত-বন্দেগি, দান-খয়রাত, পারস্পরিক সহানুভুতি ও সহযোগিতায় কে কার অগ্রগামী হবে তার জন্য। মুসলিম মিল্লাত বিভিন্ন শ্রেণি ও বিভিন্ন মতাবলম্বী হয়েও যখন একই সময়ে একটি বিশেষ বিষয়ে কর্মরত হয় এবং একে অপরকে প্রত্যক্ষ করে, তখন যত জটিল বিষয়ই হোক না কেন, তা সম্পাদনে কোনরূপ অসুবিধা হয় না।
‘তেমনিভাবে সিয়াম একই সময় সারা বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বলে এটি সবার জন্য সহজ ও অনায়াস সাধ্য। আর এর মাধ্যমে ঐক্য ও সৎসাহস বৃদ্ধি পায়। এভাবে সিয়ামের প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব ফেলে। ’
সবশেষে ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, মাহে রমজানের সিয়াম বয়ে আনতে পারে আমাদের জীবনে অপরসীম কল্যাণ। সিয়ামের উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারলে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর। পানাহার থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় মিথ্যা, অন্যায়, শোষণ, জুলুম ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলে সিয়াম আমাদের জীবনে ফলপ্রসূ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৮
এসএইচডি/এমএ