ঢাকা: নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
গ্রেফতাররা হলেন- সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও মো.নাঈম হোসেন (২২)।
বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানিয়েছে, নতুন জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অনেকেই স্বেচ্ছায় গেছেন। আবার অনেককে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে গিয়ে অনেকেই ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা ছিলো না।
সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। একটি কওমি মাদরাসায় পড়তেন সাইফুল। সেখানের এক ইমামের মাধ্যমে সে উগ্রবাদে উদ্ভুদ্ধ হয়ে হিজরতে যায়। তবে হিজরতে গিয়ে কি করবে সেটি সাইফুল জানতেন না।
সিলেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে সাইফুলসহ তিনজন প্রথমে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাদের আরও ৪ জন হিজরতকারীর সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে তারা বাসে করে বান্দরবানের দিকে রওনা হয়। রাস্তায় তাদের ফোন ও বাসা থেকে নিয়ে আসা টাকা সংগঠনটির এজেন্ট তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। এরই মাঝখানে তাদের চুল ও দাড়িও কেটে ফেলা হয়।
পরে সাইফুল ইসলাম বান্দরবানে গিয়ে দেখেন তাদের সঙ্গে একই বাসে আরও ১০ জন হিজরতকারী এসেছিলেন। বান্দরবান থেকে তারা থানচি যায়, সেখান থেকে এক রাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছায়।
সিটিটিসির এই কর্মকর্তা বলেন, নাঈম হোসেন রাজধানীতে শেরেবাংলা কৃষি ইনস্টিটিউশনের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। করোনার সময় বন্ধ থাকায় তিনি বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে বিশুদ্ধভাবে কোরআন শেখার জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন নাঈম। সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক হুজুরের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্ভুদ্ধ হন তিনি।
পরে ঢাকায় আসার পর হল থেকে তিনি কাউকে কিছু না বলে গত বছরের ২ অক্টোবর কুমিল্লায় সেইফ হাউজে চলে যান। সেখান থেকে নাঈম একইভাবে আরও ৮-১০ জনের সঙ্গে থানচি হয়ে পাহাড়ের প্রশিক্ষণ শিবিরে চলে যান।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে রুটিন মোতাবেক সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো হিজরতকারীদের। সারাদিন তারা বিভিন্ন শারীরিক ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতেন। রাতে তাদের সংগঠনের বিভিন্ন সিনিয়র নেতারা বয়ান দিতেন। এই বয়ানের মাধ্যমে তারা অল্প কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারেন শামিন মাহফুজ এই সংগঠনের প্রধান।
শামিন মাহফুজ ক্যাম্পের যেই কক্ষে থাকতেন সেখানে সশস্ত্র পাহাড়া থাকতো। কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে আসলে শুধু শামিন মাহফুজের কক্ষে গিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম ক্যাম্পটিতে ৭-৮ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শামিন মাহফুজ সিদ্ধান্ত নেয় তারা মিজোরাম সীমান্ত লাগোয়া কোনো পাহাড়ে নয়তো বা মিজোরামের ভেতরে কোথাও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করবেন।
কিন্তু সেখানে যেতে না পেরে তারা ফিরে আসেন। পরে তাদের ক্যাম্পে একদিন জেএসএস হামলা করে এই ভেবে যে এটি কুকি-চিনের ক্যাম্প। পরে শামিন মাহফুজ সেখান থেকে আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি করেন।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এরইমধ্যে সাইফুল ইসলাম তুহিনসহ সিলেট থেকে আসা ৩ জন এই প্রশিক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিদ্রোহ করেছিলেন। তারা সেখান থেকে ফেরত আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের বিদ্রোহের বিষয়টি টের পেয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালায় সংগঠনটির কমান্ডাররা।
তাদের সারাদিন গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হতো ও দোররা মারা হতো। এক পর্যায়ে তারা নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আবার সংগঠনের কার্যক্রমে ফিরে আসতে চায়। পরে তাদের দিয়ে সারা দিন ক্যাম্পের সকল কাজ করানো হতো।
তিনি বলেন, গত অক্টোবর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন পাহাড়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান চালায় তখন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইফুল ও নাঈম হাঁটতে হাঁটতে একটি মার্মা গ্রামে গিয়ে উঠে।
পরে ওই গ্রামের লোকজন তাদের ধরে কুকি-চিনের কাছে দিয়ে দেয়। কুকি-চিন তাদের পরিচয় জানতে পেরে এক মাস নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। শেষে তারা সূর্য ও বাড়ি ঘর দেখে দীর্ঘ এক মাস হেঁটে বান্দরবানে শহরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে।
নভেম্বর ২৫ তারিখে তারা বান্দরবানে আসে। এরই মধ্যে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। গোয়েন্দা নজরদারির এক পর্যায়ে সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ও ঢাকা থেকে নাঈমকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ডে বিস্তারিত জানা যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২২
পিএম/এসএএইচ