ঢাকা, রবিবার, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

চুড়িহাট্টা ট্রাজেডি

ওয়াহেদ ম্যানশনে দুই ব্যাংক, নিচতলায় দোকান: ক্ষতিগ্রস্তরা নাকাল

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
ওয়াহেদ ম্যানশনে দুই ব্যাংক, নিচতলায় দোকান: ক্ষতিগ্রস্তরা নাকাল চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন এখন অনেকটাই জাঁকজমকপূর্ণ

ঢাকা: পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন এখন অনেকটা জাঁকজমকপূর্ণ। ভবনের নিচতলায় রয়েছে বিভিন্ন দোকানপাট, দ্বিতীয় তলায় দুটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, তৃতীয় তলায় সামনের অংশটি খালি থাকলেও ভবনের চতুর্থ তলায় রয়েছে বসবাস।

দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ভয়াবহ এক আগুনের ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল ভবনটি। প্রাণ হারান অনেকেই।  

ক্ষতিগ্রস্ত এই ভবন থেকে মুনাফা কুড়িয়ে নিচ্ছেন ভবন মালিকেরা। অথচ ঘটনার ৪ বছর পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে সৃষ্ট ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ প্রাণ হারান ৭১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনার চার বছর পূর্ণ হলো আজ।

ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যান মো. জুম্মন। তার ছেলে মো. আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই সহোদর মোহাম্মদ হাসান ও মোহাম্মদ সোহেল ওরফে শহীদকে আসামি করা হয়।  

এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১২ জনকে মামলায় আসামি করা হয়। ২০২২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের মালিক দুই সহোদর মোহাম্মদ হাসান ও মোহাম্মদ সোহালে ওরফে শহীদসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ।  

অভিযোগপত্রে অন্য আসামিরা হলেন- রাসায়নিকের গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল ইকবাল, ম্যানেজার মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াদ আতিক, মো. নাবিল ও মোহাম্মদ কাশিফ।

কিন্তু মেরামতের পর আবার বাণিজিকভাবে ভবনটি চালু করেছেন স্বত্বাধীকারী সহোদর মোহাম্মদ হাসান (৫০) ও মোহাম্মদ সোহেল (৪৫)। যদিও ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের তদন্তের পর অভিযোগ গঠন হয়ে আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।  

কিন্তু ঘটনার চার বছরেও নিহত ও আহতদের কারও পরিবারই কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। এই আগুনের ঘটনায় সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই এখন পথের ফকির। অনেকেই অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করছেন। যদিও ক্ষতিগ্রস্ত এই ভবন থেকে মুনাফা কুড়িয়ে নিচ্ছেন ভবন মালিক ও মামলার আসামি দুই সহোদর হাসান ও সোহেল।

রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) চুড়িহাট্টা এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের নিচতলায় সামনের অংশে রয়েছে চারটি খাবারের দোকান। ভবনের পেছনে রয়েছে দুটি প্লাস্টিক দানার প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় তলায় দুটি ব্যাংক। তৃতীয় তলায় সামনের অংশটি খালি রয়েছে। চতুর্থ তলায় ফ্ল্যাট করে রাখা হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, যদিও ঘটনার পর এই ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ভবন মালিক বিভিন্ন জায়গায় তদবির করে পুনরায় এই ভবনটি মেরামত করেই বাণিজ্যিকভাবে চালু করেন। ঘটনার সময় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত পাশে যে ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, বর্তমানে সেটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে।  

চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় নিহত হন মাহির উদ্দিনের (২২) । ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত পাশে তাদের বাড়ি।  

নিহত মাহিরের বাবা মো. নাসির উদ্দিন (৬২) বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছেলে হারিয়েছি, আমার যে কী বেদনা, তা প্রকাশ করার মতো নয়। মামলার আসামি অনুমতি না নিয়ে ভবন মেরামত করে ফেলে ইনকাম শুরু করেন। অথচ এই ঘটনায় যাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চার বছরেও তাদের কেউ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। সিটি করপোরেশন ২১ জনকে নিম্ন পদে চাকরি দিয়েছে কিন্তু তাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়নি। দুজনকে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের দুটি দোকান দিয়েছে। তাও ওই দোকান পেতে হলে ১২ লাখ টাকা সিটি করপোরেশনকে জমা দিতে হবে। তাই এখনও দুইজনের কেউই দোকান পায়নি।

তিনি বলেন, নিমতলীর ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সরকার তো তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু চুরিহাট্টার ঘটনায় কেউ কোনো সহযোগিতা পায়নি।  

হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশে নন্দ কুমার দত্ত রোডে রয়েছে মেসার্স হাবিব এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্লাস্টিক দানার প্রতিষ্ঠান।  

প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. হাবিব বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার সময় আমার এই প্রতিষ্ঠান এই ভবনেই ছিল। আগুনের ঘটনার ১০ মিনিট আগে আমি দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যাই। এরপরই ঘটে মর্মান্তিক এই ঘটনা। আল্লাহ আমাকে হায়াত দান করেছেন তাই বেঁচে আছি। ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছিল। আমি পথে বসে গিয়েছিলাম। পরে আমার বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অনুদান পাইনি।

সেদিন যা ঘটেছিল চুড়িহাট্টায়

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে আকস্মিক যানজটের সৃষ্টি হয়। এই সময় হঠাৎ বিকট শব্দে এক বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চুড়িহাট্টা মোড়ে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনসহ আশেপাশে ছড়িয়ে যায় আগুন। কেউ পালানোরও সুযোগ পায়নি সেখান থেকে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলা থেকে বুলেটের মতো ছুটে বের হতে থাকে আমদানিকৃত বিদেশি সব সুগন্ধির (বডি স্প্রে) ধাতব বোতল। মোড়ের তিনটি সড়কের অনেকদূর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা, ভ্যান পিকআপভ্যান, প্রাইভেটকার সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।  

সেখানে থাকা যাত্রী, পথচারীসহ ৭১ জন প্রাণ হারান। আহত হন অন্তত শতাধিক। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লাগা ওই আগুন জ্বলতে থাকে পরদিন সকাল পর্যন্ত। আগুনের প্রচণ্ড তাপে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলের কাছে যেতে পারেননি ওই রাতে। আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে ঘটনাস্থল থেকে একে একে ৭১টি মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। পরে নিহতের স্বজনদের মাধ্যমে ও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মরদেহ শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।    

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পরে ঘটনার তদন্তে নামে অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ মোট ৫টি সংস্থার তদন্ত কমিটি।  

মাঠ পর্যায়ে ঘুরে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং ঘটনাস্থলের বিভিন্ন আলামত বিচার বিশ্লেষণ করে এই কমিটিগুলো তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করে। তবে সবগুলো প্রতিবেদনেই আগুনের সূত্রপাত হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় স্প্রে (কেমিক্যাল) গোডাউন থেকে হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়।  

হদিস মেলেনি ‘পার্ল ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল’র মালিকদের

‘পার্ল ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করত। এই প্রতিষ্ঠানটি অন্তত তিন দশক ধরে সুগন্ধী ও কসমেটিকস জাতীয় পণ্য আমদানি ও সরবরাহ করে আসছিল। পার্ল ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের মূল অফিস ছিল পুরান ঢাকার চকবাজারের ৬৬ মৌলভী বাজারের তাজমহল মার্কেটে।  

এছাড়া হাতিরপুলের ১৩/১ নম্বর সোনারগাঁও রোডে কাশেম সেন্টারের ছয়তলায় একটি ছিল। ঘটনার পর তাদের এসব ঠিকানায় গিয়ে অফিস গেট তালাবন্ধ থাকতে দেখা যায়। জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠনটির অন্যতম নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ কাশিফ এবং দুই পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ, মোজাম্মেল ইকবাল ঘটনার পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কারও কোনো হদিস পায়নি পুলিশ।

কসমেটিকস ও সুগন্ধী আমদানিকারক একাঠিক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ‘পার্ল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি সুগন্ধী আমদানি করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল সুগন্ধী ক্যান তৈরি করত। এসব ক্যানেই নতুন করে রিফিল করার কারণে তা বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আর সুগন্ধী যেমন দাহ্য কেমিকেল এবং সঙ্গে গ্যাসও দাহ্য। রিফিলের কারণেই ওই গোডাউনে গ্যাস চেম্বার তৈরি হয়।  

এছাড়া চুড়িহাট্টা মোড়ে অনেক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মোড়ে প্রায় সব সময় (বডি স্প্রে) সুগন্ধীর ঘ্রাণ পাওয়া যেতে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, পার্ল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের মালিকেররা ভারতের মারোয়ারি গোত্রের লোক। বাংলাদেশে তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তাদের যেসব ঠিকানা দেওয়া ছিলো সেগুলোতে গিয়ে তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
এসজেএ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।