ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে সরকারের দুই প্রস্তাব

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৩
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে সরকারের দুই প্রস্তাব

ঢাকা: জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নিতে বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা চেয়ে দুটি প্রস্তাব দিয়েছে সরকার।

বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ‌‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম’ বিষয়ক সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এ কথা জানান ।

ব্রিফিংয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রথম প্রস্তাব হলো- রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার খরচ বহন করা। আর দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো- রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আরও নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা।

প্রথম প্রস্তাব প্রসঙ্গে মুখ্য সচিব বলেন, সরকার ভাসানচরে এক লাখ লোকের বসবাসের জন্য আবাসন তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে সেখানে ৩০ হাজার নেওয়া হয়েছে। আরও ৭০ হাজার লোক সেখানে আমরা নিতে চাই। এই স্থানান্তর ব্যয়বহুল বিষয়। বন্ধু রাষ্ট্র যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করে, রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়ার খরচ তারা যেন বহন করে। প্রধানমন্ত্রী এটি সিরিয়াসলি চাইছেন।

দ্বিতীয় প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ভাসানচরে যে জমি আছে, তার তিনভাগের একভাগ আমরা ব্যবহার করেছি। বাকি দুই ভাগ জায়গাতেও প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন অবকাঠামো নির্মিত হোক এবং আরও রোহিঙ্গা সেখানে নেওয়া হোক। এই নতুন অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অত্যধিক ঘনবসতি ও তাদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে অবস্থানের কারণে সেখানে বেশ কিছু সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে, মারামারি হচ্ছে। সেখানে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটে, নিজেদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটে, অপহরণ আছে, পাচার আছে, নিজেদের বিরোধের কারণে জিম্মি করার ঘটনা ঘটছে। ফলে এর একটা সামাজিক কুফল আছে। অনেকে বিভিন্ন ধরনের মাদকের কারবারের সঙ্গে জড়িত।

তিনি বলেন, এসব কারণে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছি, আমরা বেশি মানুষকে আমরা ভাসানচরে নিয়ে যাব, তাদের নিরাপত্তা বেশি হবে, তেমনি তাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা ভালো হবে।  

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান এবং হাস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনসহ কৃষি কাজের সুযোগ ও অধিকতর ভালো পরিবেশ ও জীবনযাপনের সুযোগের কথা জানান মুখ্য সচিব।  

এ ছাড়া ভাসানচরে নেওয়া রোহিঙ্গাদের কিছুদিন পর পর কক্সবাজারে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে আসার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে মানবিক যে সহায়তাগুলো পেয়ে থাকি, ২০২২ সালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মানবিক কাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থা, আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে আমাদের দিক থেকে চাওয়া ছিল ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু তার ৬২ শতাংশ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা বৈদেশিক সহায়তা পাইনি। ৫৮৬ মিলিয়ন ডলারের মতো পেয়েছি। এই সহায়তা আরও বাড়াতে বলেছি।

তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, শুধু ভাসানচরকে তৈরি করার জন্য সরকার প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে,  যা ৫৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৭ থেকে গত বছর পর্যন্ত নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, পরিবেশের ক্ষতি এগুলো বাদ দিয়েও বিভিন্ন সময় সরকারের প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা এই কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পেছনে খরচ হয়েছে, যা দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এই মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রায় ২২টি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের সেবা দিচ্ছে। এখানে সরকারের নিরাপত্তা, প্রশাসন, ম্যানেজমেন্ট, বিভিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য প্রায় ১০ হাজার সরকারি কর্মচারী টেকনাফ, উখিয়া ও নোয়াখালীর ভাসানচরে কাজ করছে। এই হিসাব কিন্তু আমাদের দেওয়া হিসাবের বাইরে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের ফলে পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমরা জানিয়েছি, এই রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে আমাদের যে প্রকৃতি, উখিয়াতে যেখানে এখন রোহিঙ্গারা আছে, সেখানে ৮ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৭ দশমিক ৫ একর সামাজিক বনায়ন ধ্বংস হয়েছে। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে ৪ হাজার ১৩৬ একরের বেশি। এ ছাড়া অন্যান্য বন সবুজ এলাকাসহ প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি আমাদের বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি অপূরণীয় একটি ক্ষতি।

মুখ্য সচিব বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আরও বেশি ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসে তারা আরও চাপ তৈরি করবেন।

ব্রিফিংয়ের আগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৭ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই বৈঠকে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ত্রাণ ও দুর্যোগ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন, মানবিক কার্যক্রম বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, মার্চ ২, ২০২৩
এমইউএম/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।