সৈয়দপুর, (নীলফামারী) থেকে ফিরে: পয়োবর্জ্য (মানুষের মল, মূত্র) ও গৃহস্থালি ময়লা আবর্জনা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ফেলে দেওয়া ছাড়া এসবের আর কোনো কাজই নেই, কিন্তু আদতে তা নয়।
দেশের উত্তরের জনপদ সৈয়দপুরে ব্যতিক্রমী এই কাজটি যৌথভাবে করছে সেখানকার পৌরসভা, ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস) ফাউন্ডেশন। টাঙ্গাইলের সখীপুরেও রয়েছে আরেকটি পাইলট প্ল্যান্ট। ইতোমধ্যেই পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সারাদেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ওই প্ল্যান্টগুলো।
পরিবেশবান্ধব ওই কার্যক্রমের সুফল পাচ্ছেন জনপদের মানুষ। সেখানকার নালা-খালগুলোতে এখন আর পয়োবর্জ্য দূষণ নেই। মানুষ পৌরসভায় নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবেদন করলেই প্রশিক্ষিত জনবল বাড়ি গিয়ে পয়োবর্জ্য নিয়ে আসছে প্ল্যান্টে। একটুখানি ময়লাও এদিক-ওদিক ছড়াচ্ছে না। প্রক্রিয়া শেষে সেই ময়লা থেকে হয়ে যাচ্ছে সার। ব্যবহার হচ্ছে ফসলের মাঠে। পৌর এলাকার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সুড়কি মহল্লায় ১৭০ শতক জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে এই প্ল্যান্ট।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব এই কর্মযজ্ঞ। সংক্রিয়ভাবে হাতের কোনো রকম ছোঁয়া ছাড়াই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চলছে এখানকার কর্মযজ্ঞ।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার (প্রকৌশল) শাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে এ প্রকল্প শুরু হয়। ২০২১ থেকে মানুষ সেবা পেতে শুরু করে। মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এসকেএস ফাউন্ডেশন ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্ল্যান্ট করে। সেটা দিয়ে পৌরসভায় সার উৎপাদন হয়।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত (২৮ ফেরুয়ারি) সর্বমোট দুই হাজার সাতশ বাড়ি এ সেবা নিয়েছে। প্রতিবছর এই প্ল্যান্ট থেকে ৩শ ৭৯ মেট্রিক টন অর্গানিক সার প্রস্তুত করা সম্ভব। এখন ৫০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে। এ সার যাচ্ছে কৃষি জমিতে। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা। কৃষি অফিসারদের মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে প্রান্তিক কৃষি প্রান্তিক কৃষি পর্যায়ে।
পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন:
পুরো প্রক্রিয়াটি দেখার জন্য প্রথমেই সৈয়দপুর পৌরসভার ছয় নম্বর ওয়ার্ডের ডাক্তার পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মশিউর রহমানের বাড়িতে সেপটিক ট্যাংকের পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করতে পৌরসভার নিজস্ব পরিবহন ভেকুট্যাক প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়ে উপস্থিত। দুইজন কর্মী সেপটিক ট্যাংকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পাইপ ঢুকিয়ে বর্জ্য বের করে গাড়িতে স্থানান্তর করছেন। এই প্রক্রিয়ায় একটু ময়লাও বাইরে পড়তে দেখা যায়নি। দুর্গন্ধও তেমন ছড়ায়নি।
স্থানীয়রা বলছেন এটি দারুণ পদ্ধতি আগে এই বর্জ্য ফেলতে হলে সুইপার ডাকতে হতো। আলাদা দিনমজুর ডেকে গর্ত খুড়তে হতো। এখন কিছুই করতে হয় না। ভেকুট্যাক এসেই ময়লা নিয়ে যায় কোনো ঝামেলা নেই।
পৌর এলাকার ডাক্তার পাড়ার ওই বাড়ির মালিক মো. মশিউর রহমান বলেন, পৌরসভায় আবেদন করার তিন দিনের মাথায় সেবা পাচ্ছি। এটি পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম।
ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী বলেন, এ প্ল্যান্টের কার্যক্রমের ফলে পৌরসভার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখন আর খালগুলোতে পয়োবর্জ্য ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। আগের মতো যেখানে সেখানে ময়লা পড়ে থাকে না।
কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী বলেন, এক হাজার লিটার পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করতে এক হাজার টাকা এবং সাড়ে তিন হাজার লিটার পরিষ্কার করতে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয় সেবা গ্রহিতাকে। পৌরসভায় আবেদন করতে হয়। আবেদনের কয়েকদিনের মাথায় বাড়িতেই পৌঁছে যায় পৌরসভার নিজস্ব পরিবহন ভেকুট্যাক।
মানে ভালো এই সার:
বাজারের অন্য জৈব সারগুলোকে এই সার মানে ভালো বলে ইতোমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন ওয়াটার এইডের গবেষক দল।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার (প্রকৌশল) শাখাওয়াত বলেন, প্ল্যান্টের একটি কোণায় কয়েকটি গাছের গোড়ায় আমরা ২শ গ্রাম করে এই সার প্রয়োগ করে দেখেছি গাছগুলোর গ্রোথ বেশ ভালো। সমাজ কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস) ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মো নাজমুল হাসান তফাদার বলেছেন ইতোমধ্যে পারিবারিক পুষ্টি বাগানে ৭৪ কৃষক এই সার ব্যবহার করেছেন তারাও ভালো বলেছেন।
আহসান উল হক বাবু নামের এক কৃষক তার ড্রাগন ফল বাগানে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে গেছেন দুই মেট্রিক টন সার।
সৈয়দপুর শহরের সুরকি মহল্লা এলাকায় প্ল্যান্টটিতে গিয়ে দেখা যায় অন্যরকম আবহ। এখানে পয়োবর্জ্য নিয়ে কর্মযজ্ঞ চললেও প্রথম দেখায় কেউ বুঝতেই পারবে না। সাজানো গোছানে এই আঙিনার বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে সুদৃশ্য ফুল-ফলের বাগানও। সেখানে আছে ডায়িং বেড। বেডে রয়েছে হরেক রকম পাথর। পয়োবর্জ্যের ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে ওগুলো। এতে আটকে যায় অজৈব বর্জ্য।
পাথরের তিন স্তর পার হয়ে তরল অংশ নিচে নেমে যায়। তারপর সেটা যায় অন্য আরেক বেডে। তিন দিন পর কালো রঙের তরল বিভিন্ন বেড ঘুরে মোটামুটি স্বচ্ছ ও দুর্গন্ধমুক্ত হয়। ওই তরলেই মিশে আছে গাছের জন্য দরকারি পুষ্টি উপাদান। সেটাকেই কী করে সুচারুভাবে সার হিসেবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চলছে গবেষণা।
আরও দেখা গেছে, পয়োবর্জ্য থেকে পানি বের হয়ে যাওয়ার পর পচনশীল উপাদানগুলোর সঙ্গে আনুপাতিক হারে মিশিয়ে নেওয়া হয় কাঁঠের গুড়ি। এরপর আরও কিছু দিন রাখা হয় শেডে। কয়েকদিন পর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেগুলো আবার নেডে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তা চলে যায় ৫৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার একটি ঘরে। সেখানেই মরে যায় ক্ষতিকারক সব ব্যাক্টেরিয়া। এরপর প্যাকেটজাত হয়ে চলে আসে বাজারে।
দীর্ঘ ১১ সপ্তাহের এই প্রক্রিয়ার পরে এই পয়োবর্জ্যে আর কোনো জীবাণু বা দুর্গন্ধ থাকে না। পরিণত হয় অর্গানিক সারে।
ব্যবহারকারী কৃষকরা বলছেন বাজারের প্রচলিত অন্য সার থেকে এ সারের গুণগত মান ভালো।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার (প্রকৌশল) শাখাওয়াত বলেন, কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হলে কিছু প্যারামিটার ফলো করতে হয়। এর জন্য প্রতিমাসে আমরা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে নমুনা পাঠিয়ে থাকি। সেখানে ১৫টি প্যারাটিার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, রংপুর বিভাগীয় গবেষণাগারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সৈয়দপুরের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের নমুনা আমরা ১৫টি প্যারামিটারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। সরকারি নির্দেশের সঙ্গে নমুনার প্রাপ্ত ফলাফল মিলিয়ে দেখা হয়। এই সার কৃষি কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এখন পর্যন্ত ক্ষতিকারক কিছু পাওয়া যায়নি।
সৈয়দপুরের কামারপুকুর ইউনিয়নের ওশুর খাই গ্রামের ড্রাগন ফলচাষি আহসান উল হক বাবু বলেন, এ সারের গুণগত মানের কথা শুনে দুই মেট্রিক টন নিয়ে প্রয়োগ করেছি।
ফলাফলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারের কার্যকারিতা বোঝার জন্য আরও সময় লাগবে। আশা করা যাচ্ছে, এ সারে জৈবগুণ বেশি পাওয়া যাবে।
দৃষ্টান্ত হতে পারে:
পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই প্ল্যান্টকে পরিবশের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। আবার কেউ কেউ বলছেন এটা স্পর্শকাতর বিষয়ও। পয়োবর্জ্যে অনেক ধরনের ক্ষতিকারক পার্টিকেলও থাকতে পারে। সেসব মাটিতে গিয়ে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে কিনা সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবশে বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্ল্যান্ট রয়েছে। নেপালের কাঠমুণ্ডতে এই ধরনের একটি প্রকল্প দেখেছি। পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেক সাবধানতার সঙ্গে করতে হয়। এটি সেনসেটিভ বিষয় কারণ এ বর্জ্যে অনেক ধরনের ক্ষতিকারক পার্টিকেল থাকতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি ইতিবাচক ফল আসে তাহলে এটিকে পাইলটিং ধরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অন্য এলাকাগুলোকেও এ ধরনের প্ল্যান্ট করা যায়। কারণ মানুষ বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের পয়োবর্জ্যও। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় যদি এটিকে ব্যবহার করা যায় তাহলে পরিবেশের জন্য ইতিবাচক। সামগ্রিকভাবে এ প্ল্যান্ট পরিবশের জন্য ইতিবাচক। এ কার্যক্রমের ফলে খাল ও নালাগুলো পয়োবর্জ্যের দূষণ থেকে রক্ষা পাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২৩
এসএইচডি/এএটি