বাগেরহাট: বাগেরহাটের মোল্লাহাটে শেখ মনিরুজ্জামান (৪২) নামে এক দিনমজুরকে চোর সন্দেহে বেঁধে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে স্থানীয়রা। নির্যাতনের দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, মনিরুজ্জামানকে ভ্যান থেকে নামিয়ে ছাগল চোর আখ্যা দিয়ে একটি গামছা দিয়ে দুই হাত বাঁধছেন এক ব্যক্তি। পরক্ষণে আরও কয়েকজন এসে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে তাকে মাটিতে ফেলে দেন। বার বার কাঁদতে কাঁদতে তিনি চোর না বলে তাদের কাছে আকুতি করতে থাকেন। কেউ তার কথা না শুনে মারতেই থাকেন। পরে কয়েকজন এসে তার পা বেঁধে ফেলেন।
অপর একটি ভিডিওতে আরও নির্মমভাবে তাকে আঘাত করতে দেখা গেছে। বাঁধা অবস্থায় হাত, পা ও পিঠে আঘাত করতে করতে একজন হাঁপিয়ে গেলে আরেকজন এসে মারছেন। মার খেতে খেতে জ্ঞান হারালেও তাকে মারতে থাকনে তারা। যারা মারছিলেন পাশে থাকা ব্যক্তিরা তাদের উপর করে, সোজা করে, পায়ে, তালুতে মার বলে নির্দেশনা দিতে শোনা যায়। জ্ঞান ফিরলে কয়েকজন জড়ো হয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তখন ছাগল চুরির পাশাপাশি এলাকায় গরু চুরির ঘটনায়ও তাকে অভিযুক্ত করতে শোনা যায়।
গত শনিবার (১১ মার্চ) মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের ঘোষগাতি বাজারে এ ঘটনা ঘটে। পরে নির্যাতনের শিকার দিনমজুর শেখ মনিরুজ্জামানকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তবে ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও মামলা হয়নি।
আহত শেখ মনিরুজ্জামান উপজেলার পূর্ব দারিয়ালা গ্রামের প্রয়াত ইসলাম শেখের ছেলে। ভূমিহীন হওয়াতে গাংনী মাতারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের দেওয়া একটি ঘরে থাকন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার মনিরুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় মাতারচর এলাকার জনৈক জাহিদ তার অসুস্থ ছাগল নিয়ে চিকিৎসার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে যান। সেখানে অসুস্থ ছাগলকে চিকিৎসা করিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে ঘোষগাতী গ্রামের কয়েকজন তাদের চোর সন্দেহে গতিরোধ করেন।
আহত শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আমি আর আমার এক চাচা জাহিদ আসছিলাম মোল্লাহাট পশু হাসপাতালে। সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট করায়ে ফিরে যাওয়ার পথে ছাগলের মালিক জাহিদ চাচাকে ভ্যান রানিং (চলন্ত) অবস্থায় একটা বারি দেয় এক ব্যক্তি। ওই বাজারের ওখানে কয়েকজন আগে থেকে দাঁড়ানো ছিলেন। পরে আরও লোক জড়ো হয়। বারি দিলে চাচা (জাহিদ) দৌড় দেয়। তখন তারা বলে সে চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। পরে লোকজন জড়ো হলে আমারে মারধর করে। আমি কাজ করি। আমাকে মিথ্যে চোরের অপবাদ দিয়ে প্রচুর মারছে। মারতি মারতি অনেকগুলো লাঠি ভাঙিছে আমার গায়। আমি জ্ঞান হারায় ফেলে ছিলাম। সেখানে লোক ছিল প্রচুর, প্রায় ৪০-৫০ জন। কিন্তু মারছে তিন চারজনে। সবাইরে চিনি না। একজন ছিল ওয়ার্কসপে কাজ করে মাহামুদ নাম।
আমি বারে বারে হাতে পায়ে ধরে বলছি, আমারে মারার আগে একটু যাচাই করে নেও। আমি চোর না, কেউ কোনো কথাই শুনেনি। আমাকে শুধু শুধু মারছে।
সেদিন ওই বাজারে মনিরুজ্জামানকে মারধরের ঘটনায় জড়িত কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় দুই যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলাকায় গরু চুরি বেড়েছে। এ বিষয়ে থানা পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয় না। তাই মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
মনিরুজ্জামানের মা করিমন নেছা বলেন, আমরা খুব গরিব। কিন্তু কখনও এমন অভিযোগ কেউ দিতে পারবে না। এইভাবে মানুষ মানুষকে মারে। এর কী কোনো বিচার পাবো?
মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. নাহিদুল ইসলাম বলেন, গণপিটুনির শিকার এক ব্যক্তিকে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীর জুড়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। তবে কোথাও ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেনের (লাঠিজাতীয় কিছু) আঘাত। উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোমেন দাস মোবাইল ফোনে বলেন, ঘটনা জানার পর উভয় পক্ষকে থানায় ডাকা হয়। তাদের দাবি এটি ভুল বুঝাবুঝি। ভুক্তভোগী পরিবারের মামলা চালানোর আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে জানিয়েছে। তাদের কোনো অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত দিয়েছেন। বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে।
তবে একটি সূত্র বলছে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে পরিবারটিকে মামলা করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৩
আরএ