ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৩১ মে ২০২৪, ২২ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পেট চালাতে শেষ সম্বল নিয়ে রাস্তায় বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৩
পেট চালাতে শেষ সম্বল নিয়ে রাস্তায় বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা

ঢাকা: বঙ্গবাজার মহানগরী কমপ্লেক্সে পাঁচটি ও আদর্শ মার্কেটে একটি দোকান ছিল শাহেদুল ইসলামের। এক্সপোর্টের প্যান্ট, থ্রি-কোয়ার্টার, টু-কোয়ার্টার বিক্রি করে ভালোই চলছিল তার দিন৷ অভাব অনটন ছিল না সংসারে।

কিন্তু হঠাৎ লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে তার জীবন।

বঙ্গবাজারে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শাহেদুলের ছয় ছয়টি দোকান। বাঁচাতে পারেননি সেসব দোকানের একটি সুতাও। শেষ সম্বল বলতে আছে শুধু বরিশাল প্লাজার গোডাউনে থাকা কিছু প্যান্ট। পেট চালাতে তাই সেসব প্যান্ট বিক্রি করতে রাস্তার পাশে বসেছেন তিনি।

শুধু শাহেদুল নয়, তার মতো আরো অনেক নিঃস্ব ব্যবসায়ী তাদের শেষ সম্বল নিয়ে রাস্তার পাশে বসেছেন। উদ্দেশ্য ঈদের আগে যতটুকু পারা যায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া।

শুক্রবার (৭ এপ্রিল) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সদর দপ্তর ও পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটের মধ্যবর্তী হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তার ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোশাক নিয়ে বসেছেন অন্তত ১২-১৫ জন ব্যবসায়ী৷ কেউ বিক্রি করছেন প্যান্ট, কেউ শার্ট, কেউবা পাঞ্জাবি। কেউ পোশাক এনেছেন বেঁচে যাওয়া গোডাউন থেকে, কেউবা নতুন করে কিনেছেন। একেকজন একেকভাবে বসলেও, তাদের সবারই দোকান পুড়েছে আগুনের লেলিহান শিখায়।

শাহেদুল ইসলাম সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহানগরী কমপ্লেক্সে তার ৪৯৩-৯৪, ৫৮৫-৮৬ ও ৬০১ নম্বর দোকান ছিল। আর আদর্শ মার্কেটে ছিল ৫০ নম্বর দোকান। সম্প্রতি আগুনে তার সবগুলো দোকান পুড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পুড়েছে ৩০-৩৫ লাখ টাকার মালামাল। শুধু ফারিয়া ফ্যাশনেই (৬০১ নং দোকান) ছিল ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার প্যান্ট। সেই দোকানে ক্যাশে ছিল ৫৬ হাজার টাকা। আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, একেকটি দোকানে ২ থেকে ৫ লাখ টাকার অ্যাডভান্স ছিল। মালামালের হিসাব আর কি বলবো। ঈদে ভালো ব্যবসা করবো ভেবেছিলাম। সেই স্বপ্ন এখন পুড়ে ছাই। রোজা রেখে যে ইফতার করবো সেই টাকাটাও এখন আর পকেটে নেই। ভাগ্যক্রমে আমার বরিশাল কমপ্লেক্সে থাকা গোডাউনের মালামাল বেঁচে গেছে। দোকান তো পুড়ে গেছে, তাই পেট চালাতে রাস্তার পাশে প্যান্ট বিক্রি করতে বসেছি। যদি কিছু বেচাকেনা করে খাওয়া-দাওয়া আর বাসা ভাড়ার ব্যবস্থা করা যায় সেই আশায়।

শাহেদুলের মতো রাস্তার পাশে শিশুদের শার্ট বিক্রি করতে বসেছেন মো. সোহেল। দৈনিক ২০০ টাকা ভাড়ায় একটি ভ্যান নিয়ে সেসব শার্ট বিক্রি করছেন তিনি। তার বাড়ি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায়। ইউনিক কালেকশন নামের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে একটি দোকানে কর্মচারীর কাজ করতেন। আগুনে সেই দোকান না পুড়লেও পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে মালামাল।

তিনি বলেন, ওই দোকানে আমরা ছয়জন কর্মচারী ছিলাম। আগুনে আমাদের দোকান না পুড়লেও ওই মার্কেটের অনেকটা পুড়ে গেছে। এছাড়া পানিতে আমাদের দোকানের অনেক টাকার মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। দুই বস্তা মাল চুরিও হয়েছে৷ এখন মার্কেট ঠিক না করা পর্যন্ত তো দোকান করা যাচ্ছে না। কিন্তু পকেটে তো টাকা নেই। আবার এমন অবস্থায় মহাজনের কাছেও টাকা চাইতে পারছি না। তারও তো ক্ষতি হয়েছে৷ তাই নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু শার্ট এনে ভ্যানে করে বিক্রি করছি। এতে যদি হাত খরচটা অন্তত ব্যবস্থা করা যায়।

আরেক ব্যবসায়ী মো. সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের গুলিস্তান ইউনিটে ১৩৭৮-৭৯ নম্বর দোকান ছিল। আগুনে সব পুড়ে শেষ। এখন পেটের দায়ে পরিচিত কারখানা থেকে পাঞ্জাবি এনে এখানে রাস্তার ওপর বিক্রি করছি। আগে যেখানে প্রতিদিন ৪-৫ লাখ টাকা পাঞ্জাবি বিক্রি করতাম এখন সেখানে ৫০ হাজারও করতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২০ হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারিনি।

সিলেটের জিন্দা বাজার থেকে পাঞ্জাবি কিনতে আসা দেলোয়ার নামের এক ক্রেতা বলেন, এলাকায় আমার পাঞ্জাবির দোকান আছে। বঙ্গবাজার থেকেই আমি সব সময় পাঞ্জাবি কিনি। তাই ব্যবসায়ীদের কাছ এখনো যেসব পাঞ্জাবি আছে সেগুলোই কিনতে এসেছি।

সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আরেক ক্রেতা সবুজ মোল্লা বলেন, এ সময় আমাদের এসব ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। তারা যাতে তাদের ক্রেতা না হারান। আমরা সবসময় তাদের কাছ থেকে পোশাক কিনতাম। তাই এখনো তাদের সঙ্গে কথা বলে নিজের দোকানের জন্য প্যান্ট কিনতে এসেছি।

এদিকে প্রায় ৭৫ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকালে পুরোপুরি নির্বাপিত হয়েছে বঙ্গবাজারের আগুন। আগুন পুরোপুরি নেভানোর পর পোড়া স্তূপ সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও মেসার্স বুশরা ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান৷ এই প্রতিষ্ঠানের কাছে দরপত্রের মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকায় পোড়া স্তূপের মালামাল বিক্রি করেছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতি। পোড়া স্তূপ পরিষ্কার শেষ হলে বঙ্গবাজার মার্কেটের খোলা জায়গায় তেরপাল টাঙিয়ে আপাতত ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করা হবে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে তালিকা তৈরির কাজ চলছে৷ আগামী রোববারের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. নাজমুল হুদা।

এর আগে মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সকাল ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ৪১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। এরপর ৪৩টি ইউনিট যাওয়ার খবর জানায় ফায়ার সার্ভিস। পরে ৪৮টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টায় বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর শুক্রবার (৭ এপ্রিল) সকালে আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপনের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস।

আগুনে বঙ্গবাজার এলাকার মোট সাতটি মার্কেট পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চারটি পুরোপুরি ও তিনটি আংশিক। মার্কেটগুলো হলো- বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেট, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স, বঙ্গবাজার মার্কেট, এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কম্প্লেক্স ও আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০২৩
এসসি/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।