ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘সবাই সিটিতে থাহো কইয়া এহন খোঁচা মারে’

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৩
‘সবাই সিটিতে থাহো কইয়া এহন খোঁচা মারে’

বরিশাল: বরিশাল সিটি করপোরেশনের নগরের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাগুয়া এলাকার চর জাগুয়া সড়কের দুইপাশে ৪০টির মতো পরিবারের বসবাস। যারা কাগজে-কলমে সবাই বরিশাল নগরের বাসিন্দা।

কিন্তু কার্যত তাদের নগর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সুগন্ধা নামের একটি নদী।  

আর এর চারপাশে রয়েছে ঝালকাঠির নলছিটির দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠি গ্রামের জায়গা।  বিচ্ছিন্ন জনপদের বাসিন্দা হওয়ায় খাজনা, নগর কর দিয়েও এখানকাবাসী বাস্তবতায় বরিশাল সিটির প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা ভাতা থেকে বঞ্চিত থাকার পরও যেসব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। তার মধ্যে কার্পেটিং উঠে যাওয়া একমাত্র সড়কটির যেমন বেহালদশা, তেমনি প্রায় তিন কিলোমিটার ওই সড়কের কোথাও নেই সড়ক বাতি। আবার সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা না থাকা ২২ পরিবারের জন্য সচল থাকা একমাত্র গভীর নলকূপটিতেও সঠিকভাবে পানি উঠছে না, ফলে দৈনন্দিন কাজে অন্যত্র থেকে টেনে আনতে হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি নয়তো ব্যবহার করতে হচ্ছে নদীর পানি।



এমনকী নির্বাচন ছাড়া জনপ্রতিনিধিদেরও দেখা মেলে না এমন অভিযোগ বরিশালের সিটমহল খ্যাত চর জাগুয়া এলাকার বাসিন্দাদের।

তিন কন্যার জননী রাহিমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভোটের সোময় হইলে মোগো খোঁজ নেতে আয় হ্যারা ভোট চাইতে, আর ভোট হইয়া গ্যালে খবর নাই।  অবশ্য মোগো এহানকার ৪-৫ শো ভোট হ্যাগো না হইলেও হয়। ’

তিনি বলেন, ‘সবাই সিটিতে থাহো কইয়া এহন খোঁচা মারে, মোরা কিসের সিটিতে থাহি। এউক্যা রাস্তা হেই কবে হিরন মেয়া কইর‌্যা থুইয়া গ্যাছে। এরপর আর কেউ এইডারে ঠিক করে নাই, এহন তো এই রাস্তায় পায় হাইট্টা চলাডাও কঠিন। নদী পার হওয়ার লইগ্যা সিটি দিয়া একটা ট্রলার দেছে কিন্তু হে তো সপ্তায় দুইদিন ছাড়া চলে না, বাহি দিনগুলা মোগো ব্যাডারা কি ঘরে ঘুমাইয়া ইনকাম করবে। আবার জরুরি দরকার অইলে ফোন দেলেও তো ট্রলার আলায় ধরে না।  ধরেন রাইতে কেউ অসুস্থ হইয়া পড়ছে, হ্যারে হাসপাতালে নেতে অইবে, ট্রলার আলায় ফোন ধরবে না, আর ধরলেও কইবে আইতে পারবে না। তয় এই ট্রলার দিয়া লাভ কি, হেই দবদইব্বা হইয়া মোগো ঘুইর‌্যা বরিশাল যাইতে যাইতে তো রুগী মইর‌্যাই যাইবে। আবার চরজাগুয়ার এই রাস্তায় কোতাও বাতি নাই, ঘুডঘুইডা আন্দারে টর্চলাইট যাগো নাই হ্যারাও বা কি হরে।



তাও মোগো এউক্যা লোহার খাম্বার ব্রিজ আল্লে, হেডাও ড্রেজার আলার ভাইঙ্গা থুইয়া গ্যাছে কয়েক বছর হইছে। কিন্তু শালিস কইর‌্যা কবির চেয়ারম্যানে জরিমানা রাখলেও আইজ তামাইত হ্যাই ব্রিজ হয়নাই, হেডা হইলে তো সামনের খেওয়া দিয়া ১০ টাহা খরচ কইর‌্যা ওফার কালিজিরা জাইতে পারতাম।

ওই নারী বলেন, মোগো এহানে তো সব মানুষ গরিব, হ্যার পরও মোরা খাজনা দি, কর দি। কিন্তু সিটির কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। এরচাইয়া ইউনিয়নে থাকলে একটা ঘর তো পাইতাম। নদীতে পানি বাড়লে মোর ঘরসহ অনেকের ঘরেই তো ডুইব্যা যায়। টাহার অভাবে ঘর মেরামত করতে পারি না। হউরের জাগায় বাঁশ দিয়া কোনোরহম বানাইন্যা ঘরে তিনডা মাইয়া লইয়্যা থাকতাছি। কেউ মোগো দিকে চায় না, এমনকী খইরাইত্যা চাউলও দেয় না। ২২ পরিবারের লইগ্যা এউক্যা চাপকল (গভীর নলকূপ) বহাইয়া দিছিলো পারুলে (সাবেক নারী কাউন্সিলর), এহন আর হেডা দিয়াও পানি ওডেনা ঠিকমতো।



চাপকলে পানি না থাকায় নদী আর পুকুরে পানি ফুটিয়ে খেতে হয় জানিয়ে রেকসোনা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, কলসে কইর‌্যা নদী দিয়া পানি টাইনা আনতে হয়। এরপর হ্যা ফুডাইয়া খাই। এসব সমস্যার কারণে এখন পোলাপান এখানে থাকতে চায় না।

ষাটোর্ধ্ব বিধবা নারী কুলসুম বেগম বলেন, যারা যেডু ইনকাম হরে হেইয়া দিয়া পোলাপান পড়ালেহা করানের চেষ্টা হরে, যাতে হ্যারা ভালো চাকরি পাইয়া এই জায়গা ছাড়তে পারে। তয়, মোগো তো বয়স হইয়া গ্যাছে, এরহম হরতে হরতেই মোরা এহানে জীবনডা পার হরমু।

ওই গৃহবধূ বলেন, মোগো এহানে মুইসহ কয়েকজন বয়স্ক ও বিধবা নারী আছে। আছে বয়স্ক পুরুষও। আবার মোর একটা পোলার চোহে সমস্যা আছে। কিন্তু সব মিলাইয়া মোগো এহানে একলগে এই ২২ পরিবারের কেউ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কিছুই পায় না। চেয়ারম্যান (কাউন্সিলর) ও হ্যার অফিসের কারো কাছে গিয়ে চর জাগুয়ার কথা কইলে আর কথা হোনতে চায় না।

শুধু এসব ভাতা না মাতৃকালীন কিংবা শিশুদের জন্য বরাদ্দ থাকা কোনো ভাতাই চরজাগুয়ার মায়েরা গত কয়েক বছরে পায়নি বলে জানান লিজা ও শিউলি নামের দুই গৃহবধূ।  



লিজা বলেন, ভাতা দিয়া আর কি করমু, মোগো বাচ্চাগো কোনো টিকা দিতে হইলে পর্যন্ত নলছিটি বা নদীর ওপার শহরে যাওয়া লাগে। এফারে কেউ আইয়া টিকার কোম্পানিও করতে চায় না।  শিক্ষকরা পর্যন্ত মোগো পোলাপানরে ঠিকমতো পড়াইতে চায় না।

এহানে চরজাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানে সন্তানদের পাঠান না জানিয়ে শিউলি বলেন, ওহানে তো পোলাপানও পড়তে চায় না, এহন তো বাস্তবে ছাত্রছাত্রী নাই বললেই চলে। আবার শিক্ষকরা ঠিকমতো আসেও না, ক্লাসও নেয় না। পোলাপান দিয়া নানান কাম করায়। তাই পোলাপানরে নলছিটির কুমারখালী বা তিমিরকাঠির স্কুল মাদরাসায় পড়ায় সবাই।  এ কারণে সাফিয়া বেগম, মরিয়ম, জব্বার হাওলাদার, দেলোয়ার হোসেনসহ চরজাগুয়ার বাসিন্দারা আসন্ন সিটি নির্বাচনে এমন এক জনপ্রতিনিধি চান যিনি তাদের সুখে-দুখে পাশে থাকবেন এবং সমান চোখে সবাইকে দেখবেন।

যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন কবিরের বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, গভীর নলকূপের ত্রুটির বিষয়ে তিনি অবগত নন। আর সড়ক বাতি বসানো, ব্রিজ ও রাস্তা সংস্কারের বিষয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবনা দিয়ে রেখেছেন, তবে তার কোনো অগ্রগতি নেই।

বর্তমান পরিষদের সময়ে সব বিষয়ে সিটি মেয়র বলতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, কালিজিরা থেকে চরজাগুয়ার পাড়াপাড়ের খেয়া ও স্টাফ দিছে আওয়ামী লীগ নেতা নীরব হোসেন টুটুল। খেয়ার মাঝি সিটি থেকে বেতন নিলেও, তার কোনো হাজিরার ব্যবস্থা স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে নেই। আর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি বাপ্পীকে বাদ দেওয়ার আগে সে এটা দেখাশুনা করতেন, এখন তো তাও নেই, তাই তার খেয়াল-খুশি মতো চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০২৩
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।