ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

টাঙ্গাইলে ৫ হাজার গ্রাহকের টাকা ফেরতের উদ্যোগ, তবে...

তানভীর আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, মে ২, ২০২৩
টাঙ্গাইলে ৫ হাজার গ্রাহকের টাকা ফেরতের উদ্যোগ, তবে...

টাঙ্গাইল থেকে ফিরে: টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ফতেহপুর এলাকার বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলাম। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে পাঁচ বছরে দিগুণ মুনাফা মিলবে এমন আশায় ‘সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদ’ (এসডিএস) প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।

প্রথম দিকে প্রতিমাসে তাকে সুদ দেওয়া হতো। কিন্তু হঠাৎ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে তার টাকাও আটকে যায়। শুধুমাত্র শহিদুলের নয় এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে ওই এলাকার ৫ হাজার মানুষের।

টাঙ্গাইলের সদর উপজেলায় সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদে (এসডিএস) আটকে রয়েছে গ্রাহকের লগ্নি করা ১৯ কোটি টাকা। গ্রাহকের টাকা আটকে থাকলেও এসডিএস’র রয়েছে ১৫২ একর জমি। সেটিই অর্থলগ্নি করা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু সে জমি এখন লুটেপুটে খাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।

জানা গেছে, এসডিএস’র জমি থেকে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী রাতের আঁধারে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট গর্ত। শুধু তাই নয়, এসডিএস জমি সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের নিচ থেকেও মাটি কেটে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ব্রিজটি।

এমন পরিস্থিতিতে ৫ হাজার সদস্যর ফার্মের জমি ও ব্রিজ রক্ষায় ভুক্তভোগী, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত ৪৭ সদস্যের একটি কমিটি সোচ্চার হয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু বন্ধ করা যাচ্ছে না মাটি কাটা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী নদীর তোরাবগঞ্জসংলগ্ন তিন ইউনিয়ন দাইন্যা, পোড়াবাড়ী ও কাতুলী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের চলাচলের একমাত্র ভরসা ধলেশ্বরী ব্রিজের দুই পাড়ের মাটি এমনভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে, যেকোনো সময় ব্রিজের সংযোগস্থল ভেঙে পড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির ওপর এসডিএস প্রকল্পের খামারের প্রায় পুরোটাই গর্ত করা। স্থানীয়দের অভিযোগ, টাঙ্গাইল সদরের ১১ নম্বর কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান সুমন আহমেদের নেতৃত্বে রাতের আঁধারে চলে মাটি উত্তোলনের কাজ। তার মদদে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে একটি চক্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের মানববন্ধন, জমির মালিকদের প্রতিরোধ এবং প্রশাসনের কাছে দফায় দফায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করলেও তাতে কোনো সুফল মিলছে না।

রক্ষা কমিটি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে ১৫২ একর বা ৫০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠে এসডিএস ফার্ম প্রকল্পটি। প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের অবস্থা ছিল রমরমা। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে গ্রাহক। তবে এক পর্যায়ে গ্রাহকদের থেকে নেওয়া ১৯ কোটি টাকার মুনাফা না দিতে পারাসহ নানা ঝামেলায় প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে ৫ হাজার সদস্যের টাকা। তবে প্রকল্প বন্ধ থাকলেও জমি পড়ে থাকে।

এর মধ্যে গত ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত সরকার। এ সময় এখানে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তৎকালীন বিএনপির স্থানীয় নেতা কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সুমন আহমেদ ও কিছু প্রভাবশালীর। জমির মালিক ইসমাইল হোসেন সিরাজী আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ায় এই চক্রটির ভয়ে আর যেতে পারেননি নিজের কষ্টে তিলে তিলে গড়ে তোলা এসডিএস প্রকল্পের সম্পত্তিতে। দেওয়ান সুমন প্রথমেই প্রায় পুরো প্রকল্পের জায়গাকে বিরানভূমিতে পরিণত করে ফেলেন। এরপর মাটি বিক্রি করা শুরু করেন। গত দশ বছর ধরে জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় সুন্দর সমতল ভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত।

এলাকাবাসী জানায়, প্রায় দুই যুগ ধরে চলছে কাগমারী তোরাগঞ্জসংলগ্ন এসডিএসের নিজস্ব জমিরই ধ্বংসযজ্ঞ। পুলিশ-প্রশাসন যারাই এই জেলায় দায়িত্বে আসেন, শুরুতেই তাদের ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন সুমন ও তার বাহিনী।

ধলেশ্বরী ব্রিজসংলগ্ন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদের (এসডিএস) প্রকল্পটি থেকেই মূলত মাটি কাটা শুরু হয়। আনুমানিক ১৫২ একর (৫০০ বিঘা) জমির ওপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সবুজ বন। সঙ্গে মাছ চাষ থেকে শুরু করে গরু, হাঁস-মুরগি পালন কার্যক্রম। পুরো প্রকল্প এলাকার মাটি কাটতে কাটতে এক পর্যায়ে তা ধলেশ্বরী ব্রিজের দুই পাড়েও শুরু হয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও সুমনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ তুলেছেন।

মো. আসাদ আলী নামে এসডিএস’র এক গ্রাহকের সন্তান ইসলাম হোসেন আইয়ুব বলেন, ১৯৯৭ সালে সরকারি পেনশন পেয়ে এসডিএসে চার লাখ টাকা মুনাফার বিনিময়ে আমার বাবা বিনিয়োগ করেন। কিছুদিন আমরা লাভও পেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ এসডিএস বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা এখানকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। মালিক ইসমাইল হোসেন সিরাজি জেলে চলে যায়। আমরা চাই এসডিএস জমি রক্ষা পাক।

এ ব্যাপারে এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রিজ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বেশি মুনাফা দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয় এসডিএস। সে হিসেবে দাইন্যা, কাতুলী ও পোড়াবাড়ী ৩ ইউনিয়নের সীমানা বরাবর এসডিএস প্রকল্পের জমির ৫ হাজার সদস্যর লগ্নি করা টাকা দিয়েই কেনা। তাই জমির অধিকারও তাদের। সেই বিবেচনায় সম্প্রতি আমরা গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার শেষ অবলম্বন জমিটি রক্ষার উদ্যোগ নিই। বর্তমানে এই জমিটি নিতে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। জমিটি বিক্রি করা সম্ভব হলে গ্রাহরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন।

এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রিজ রক্ষা কমিটিরি সদস্য সচিব ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা শ্রমিক লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্বাস আলী বলেন, প্রকল্পটি থেকে প্রতিনিয়ই কোটি টাকার মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। এর প্রতিকার জরুরি। তাই আমরা আন্দোলন করছি।

টাঙ্গাইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া বলেন, অবৈধভাবে মাটি কাটার বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। তবে এ ধরনের বিষয় দেখার জন্য মূলত পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রয়েছে। আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

অভিযুক্ত বিএনপি নেতা দেওয়ান সুমন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমাকে হেয়-প্রতিপন্ন করতে এমনটি করছে। আমার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ সত্য নয়।

টাঙ্গাইল সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রানুয়ারা খাতুন বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে জেলা প্রশাসকের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। আমরা প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান চলবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, মে ২, ২০২৩
টিএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।