ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ঘূর্ণিঝড় মোখা: বাঁধ না থাকায় আতঙ্কে কয়েক লাখ মানুষ

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৩
ঘূর্ণিঝড় মোখা: বাঁধ না থাকায় আতঙ্কে কয়েক লাখ মানুষ

বাগেরহাট: উপকূলীয় জেলা হওয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস বাগেরহাটবাসীর। তবে নদীবেষ্টিত এই জেলার মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও রামপাল উপজেলার মানুষ একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকেন সব সময়।

 

কারণ এই চার উপজেলার একটা বড় অংশ রয়েছে বেড়িবাঁধের বাইরে। যার ফলে ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, এসব উপজেলার কয়েক লাখ মানুষের আতঙ্ক ততো বাড়ছে।

বিশেষ করে মোরেলগঞ্জ উপজেলার বারুইখালী, বহরবুনিয়া, পঞ্চকরণ, রামপালের ভোজপাতিয়া, পেরিখালী, মোংলা উপজেলার সোনাইলতলা, মোংলা পৌরসভার একটা অংশসহ বেশকিছু এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব এলাকা জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য যেমন বাঁধ নেই, তেমনি যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত নয়। যার ফলে যেকোন দুর্যোগে এসব এলাকার মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে।

অন্যদিকে শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদীর তীরে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে করা বেড়িবাঁধ থাকলেও, এই উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী গ্রামে ২৫০টি এবং ভোলা নদীর চরে দুই সহস্রাধিক পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে। এছাড়া বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের মাঝিডাঙ্গা এলাকায় ৫ শতাধিক পরিবার জলচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

আবার শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা থেকে সাউথখালী পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধে ফাটলের ঘটনা ঘটেছে। ফলে বাঁধ এলাকাতেও আতংকে থাকছেন সাধারণ মানুষ। গত বছর মে মাসে বেড়িবাঁধটিতে ফাটল দেখা দেয়। মুহূর্তেই ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায়।

জমি হারানো ছফেদ খান বলেন, বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা। বেড়িবাঁধের বাইরে আমার এক বিঘা (৬৫ শতক) জমি ছিল গত বছর। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায় অনেকখানি।

সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য জাকির হোসেন বলেন, শরণখোলা উপজেলাকে রক্ষার জন্য একটি টেকসই বেড়িবাঁধ আমাদের প্রাণের দাবি ছিল। সরকার বরাদ্দও দিয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছেমত কাজ করেছে ঠিকাদাররা। যেখানে মাটি দেওয়ার কথা সেখানে বালু দিয়েছে। যার ফলে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ফাটল দেখা দিচ্ছে।

মাঝিডাঙ্গা আশ্রয়নের বাসিন্দা নান্নু শেখ বলেন, নদীর পাশে থাকলেও আমাদের এখানে কোনো বাঁধ নেই। প্রতিবছরই জোয়ারের পানিতে আমাদের ডুবতে হয়। বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হাঁটু সমান পানি উঠে যায় সব জায়গায়। স্থানীয়রা মিলে যে বাঁধ দিই, তা পানির চাপ বাড়লেই ভেঙে যায়। ভাঙলে বড় স্যাররা, নেতারা দেখতে আসেন। সমাধানের আশ্বাস দিয়ে যায়। কিন্তু আমরা শুধু আশ্বাসই পাই। এই যে ঝড় আসবে শুনতেছি, আমাদের কি হবে এক আল্লাহ জানে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া এলাকার কাদের শেখ বলেন, আমাদের এই ইউনিয়নের চারপাশে নদী। ইউনিয়নের বাইরে যেতে হলে নৌকা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। জোয়ারের পানি বাড়লেই আমরা ঝুঁকিতে থাকি। এরপরে এত বড় ঝড়ের কথা শুনতেছি, আসলেই যদি বড় ঝড় হয় তাহলে আমাদের কি হবে এই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ষাটোর্ধ এই বৃদ্ধ।

বারুইখালী এলাকার বাসিন্দা ননী গোপাল বলেন, কয়েক বছর ধরে শুনতেছি পানগুছি নদীর তীর ঘেষে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হবে। কিন্তু কই বাঁধ তো নির্মাণ হয় না। মরার পরে নির্মাণ হবে?

পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ৩০ হাজার জিও ব্যাগ ও দশ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলার একটা বড় অংশকে জলচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য  ৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য আমরা ডিপিপি পাঠিয়েছি। অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন হলে দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আজিজুর রহমানের বলেন, জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় ৪৪৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেখানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৫ জন আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। জেলা সদর ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ৯ উপজেলায় ৮৪টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  

এছাড়া ত্রাণ প্রদানের জন্য ৫২২ দশমিক ৮০০ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় মোখা মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিনপূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছেন। বাগেরহাটের মোংলা বন্দর থেকে এর দূরত্ব ৯৬৫ কিলোমিটার (এ রিপোর্ট লেখার সময়)।  

এর ফলে মোংলা, পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাগর ও নদীতে থাকা সকল মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারকে নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।