ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

উপকূলীয় জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে টেকসই কর্মসূচি প্রয়োজন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২৩
উপকূলীয় জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে টেকসই কর্মসূচি প্রয়োজন

ঢাকা: জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝড়-তুফান ও বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের আমিষের জোগান দেয়। কিন্তু তাদের জীবন কীভাবে কাটে, সেটি নিয়ে আমাদের নীতি নির্ধারকরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেন না।

ভাবলেও এর প্রকৃত সুফল জেলেরা পান না। গত কয়েক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৪৫ গুণ বাড়লেও জেলেদের জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বরং সামগ্রিকভাবে তারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। তাই উপকূলীয় জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি দেখতে হবে সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের নিরিখে। এজন্য প্রয়োজন টেকসই কর্মসূচি।

বুধবার (১৭ মে) ‘উপকূলের ইলিশ ও জেলে’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।

বাপার সভাপতি সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী।

প্রবন্ধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মাছ। মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ মৎস্য খাতের অবদান। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬ দশমিক ৮১ লাখ টন, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মৎস্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এছাড়া চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম, ইলিশ আহরণে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ৪ লাখ মানুষের জীবিকা এই খাতের সঙ্গে জড়িত। তারপরও জেলেরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে এবং সমুদ্রে যারা মাছ ধরেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের অনেকের স্থায় ঘরবাড়িও নেই।

মৎস্য উৎপাদন বাড়ার পরও উপকূলীয় জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রবন্ধে বলা হয়, সমুদ্রগামী জেলেদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। মাঝেমধ্যেই জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের নৌকা-জালসহ সহায়-সম্পদ হারাতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এছাড়া বছরের একটি বড় সময় জেলেদের বেকার থাকতে হয়। সঞ্চয় না থাকায় এ সময় তাদের জীবন ধারণ করতে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়। সেই ঋণ শোধ করতে তাদের অনেক সময় আগাম মাছ বিক্রি করতে হয়।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, উপকূলের নদীগুলোতে যেসব জেলে মাছ ধরেন, তাদের বেশিরভাগ সময় সরকারের নানাবিধ নিষেধাজ্ঞার কারণে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে হয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, উপকূলে বিপুল পরিমাণ অবৈধ জালের ব্যবহার এবং বাঁধ, ব্যারেজের মতো নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে নদীর তলদেশ ও অববাহিকায় পলি জমে ডুবচর সৃষ্টি হওয়ায় জেলেরা ইলিশসহ কাঙ্খিত মাছ পায় না। এছাড়া ইলিশ ধরার বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার সময়েরও অসামঞ্জ্যসতা রয়েছে।

মীর মোহাম্মদ আলী তার প্রবন্ধে আরও বলেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় অবৈধভাবে মাছ না ধরলে মাছের উৎপাদন বাড়বে। এতে জেলেদেরই লাভ। কিন্তু তারপরও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় জীবিকার তাগিদে সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং জেল-জরিমানা উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যান জেলেরা। আবার নদীর দূষণের কারণে মাছের উৎপাদন বিশেষ করে নদ-নদীতে ইলিশের অনুপ্রবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। তাই ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে ৮টি পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। পদক্ষেপগুলো হলো-

* ইলিশ সংরক্ষণ ও প্রান্তিক জেলে জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এই দুই পরিপূরক বিষয়ের উন্নয়নকল্পে অবশ্যই সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণমূলক কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

* নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হলে সেই সময়ে শতভাগ জেলেকে খাদ্য সহায়তার আওতায় আনা এবং তাদের জেলে আইডি কার্ড প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

* বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই ইলিশের ব্যবস্থাপনা ও নিষেধাজ্ঞার সময় একই ধরনের হলে কাঙ্খিত সুফল আসবে।

* প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এবং ইলিশ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ শুরু ও তাদের সচেতন করতে হবে।

* প্রান্তিক জেলে জনগোষ্ঠীগুলির জীবন জীবিকার উন্নয়নের পাশাপাশি নদ-নদীগুলির পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপযোগী নীতিমালা তৈরির জন্য পরামর্শ দিতে হবে।

* ইলিশের উৎপাদনশীলতা হ্রাসে বৃহত্তর পরিবেশগত প্রভাবগুলিকে নির্ধারণের জন্য গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে।

* নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে ইলিশ ধরা, খাওয়া, ও বাজারজাতকরণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে।

* দখল ও দূষণের হাত থেকে উপকূলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও রক্ষা করতে হবে।

এ সময় খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আখতারুজ্জামান বাবু, পটুয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক গুলশান আরা লতিফা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল ওহাব, মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-প্রধান (ইলিশ ব্যবস্থাপনা শাখা) মাসুদ আরা মমি, মৎস্য গবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আজহার, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী নিখিল চন্দ্র ভদ্রসহ উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন সংগঠনের সংগঠক ও মৎস্যজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২৩
এসসি/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।