ঢাকা: দিনের বেলা খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় দাঁড়ানো যায় না। গরম হাওয়া মুখে লাগলে মনে হয় পুড়ে যায়।
দেশের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থা শোচনীয়। বড় লোকেরা এসি ঘরে থাকলেও নিম্ন শ্রেণি থেকে প্রান্তিক লোকজন একটু ছায়া পেতে চায়। কিন্তু মিলছে না। প্রখর সূর্যতাপ কাবু করে ফেলছে জন-জীবন। তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদ মানুষকে বসে থাকতে দেয় না।
রোববার (৪ জুন) রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে পথচারী, রিকশাওয়ালা, রাইড শেয়ারিং পারসন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তার পরিস্থিতি জানতে চেষ্টা করে বাংলানিউজ।
শাহবাগ এলাকায় গিয়ে কথা হয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ আয় করা বেশ কয়েকজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে। তারা জানান, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তাদের শরীরের ঘাম শুকায় না। কিন্তু গরমকালে তাদের ভোগান্তি হয় অনেক বেশি। গত কয়েকদিন ধরে প্রখর রোদ পড়ছে। অতিরিক্ত গরমে তাদের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। রিকশা চালাতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সংসার চালাতে, স্বজনের মুখে ভাত তুলে দিতে রাস্তায় তাদের নামতেই হচ্ছে।
একই কথা বললেন মো. ইকবাল হোসেন নামে এক রাইড শেয়ারিং পারসনের সঙ্গে। মোটরসাইকেলের মাধ্যমে যাত্রী সেবা দেওয়া এ যুবক বলেন, এই রোদে মোটরসাইকেল চালাতে কষ্ট হয়। তার ওপর দীর্ঘক্ষণ জ্যামে বসে থাকা লাগে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই বের হতে হয়। এতেও তেমন লাভ হচ্ছে না। রোদ আর গরমের কারণে এখন মানুষ মোটরসাইকেলে যেতে চায় না। কষ্ট করে হলেও বাস বা রিকশায় যায়। সেসবে অন্তত মাথার উপর ছায়া দেওয়ার মতো কিছু আছে, ফ্যান আছে। মোটরসাইকেলে গেলে রোদে পুড়তে হয়।
বাংলামোটর এলাকার বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন, গরমে ঘরের ভেতর টেকা যায় না। সারা রাত- সারা দিন ফ্যান চালু রাখতে হচ্ছে। তারপরও গরম থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়েছে। সব জায়গায় খাঁ খাঁ রোদ। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই।
এদিকে, বৃষ্টিপাত না হলে গরমের তীব্রতা কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটির নিচের পানি স্তর ধীরে ধীরে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে কম গভীরতার নলকূপে পানি উঠছে না। এর মধ্যে আবার বাড়ছে ডায়রিয়ার আশঙ্কা। সব মিলিয়ে জন জীবন শঙ্কাময় সময় কাটাচ্ছে।
তীব্র গরমের মধ্যে আরেক ভোগান্তি যানজট। এই সংকটের কারণে রাজধানীর মানুষ নাকাল। রোববার রাজধানীর বিজয়নগর, মৎস্যভবন ও পল্টন থেকে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজট দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থেকে অপেক্ষা করতে করতে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তারা হাঁটতে শুরু করেন। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য, পায়ের নিচে উনুনের তাপ- মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। তারপরও এ শহরের ভোগান্তি কাঁধে রাস্তায় নামতে হচ্ছে অফিস ও ঘরমুখো মানুষকে। এরমধ্যে আবার আবহাওয়ার সর্বশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপ প্রবাহ আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
যানজট দেখে কথা হয় বিহঙ্গ পরিবহনের হেলপার রাসেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, দেড়ঘণ্টা ধইরা গাড়ি খারায়া রইসি এক জায়গায়। যাত্রী নাইমা গেসে গা। ভিক্টোরিয়া পার্ক মোড়েত্তে জিপিও মোড় আইতে তিনঘণ্টা লাগসে। যেই গরম, গাড়ি চললে সমস্যা হয় না। কিন্তু রইদের (রৌদ্র) মধ্যে জাম (জ্যাম) লাগলে অস্বস্তি আরও বাইড়া যায়।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয় বাতাস আটকে যাওয়ার (ট্র্যাপড এয়ার) কারণে। কোনো অঞ্চলে বাতাস আটকে গেলে সূর্য তাপে সে বাতাস আরও গরম হতে থাকে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলের উচ্চ চাপের বাতাস সে অঞ্চলেই আটকে গিয়ে গরম হয়ে যায়। দেখা যায় গরম থেকে বাঁচার জন্য শহরাঞ্চলে এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করে আরাম অনুভব করে। ঘরের ভেতরে এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম তাপমাত্রাকে নিচে নামিয়ে রাখলেও কুলিং মেশিন বাইরের তাপমাত্রাকে আবার বাড়িয়ে দেয়।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তিন কারণে এবারের তাপপ্রবাহের মাত্রা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। জলীয় বাষ্প অস্বাভাবিক থাকা, দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু কম আসা এবং সাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড়ের প্রক্রিয়া তৈরি না হওয়ায় এ মৌসুমে প্রচণ্ড গরম অনুভব হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম বলেন, সাগর থেকে যে বাতাস আসে, তা হলো দক্ষিণ পূর্ব মৌসুমি বায়ু। তা আসার সময় জলীয় বাষ্প নিয়ে আসে। কিন্তু এবার বাতাসটা আসছে না সেভাবে। আর জলীয় বাষ্পও খুব কম। এছাড়া পশ্চিমা মৌসুমি বায়ুও শুকনো। এর সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বায়ু যেখানে মিশে যায়, সেখানে কালবৈশাখীর সৃষ্টি হয়। তা এখনো হচ্ছে না। কারণ জলীয় বাষ্প কম। ফলে দেশে শুকনো বায়ু প্রবেশ করছে ও তাপমাত্রা বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৩
এইচএমএস/এমজে