ঢাকা: বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়। জাল টাকা তৈরির খরচের সঙ্গে নোটের মূল্যমান বিবেচনায় সাধারণত প্রচলিত বড় নোটগুলো জাল করছিল চক্রগুলো।
এবার তুলনামূলক কম মূল্যমান অর্থাৎ ১০০ বা ২০০ টাকারও জাল নোট তৈরি চক্রের সন্ধান পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এসব জাল নোটগুলো এতোটাই নিখুঁত সাধারণভাবে দেখলে বুঝার উপায় নেই। এছাড়া কম মূল্যমান হওয়ায় মানুষের তেমন যাচাই-বাছাই না করার সুযোগ নেয় চক্রটি।
গত কয়েক মাসে এ চক্রের হাত ধরে বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে কয়েক লাখ টাকার জাল নোট। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে কৌশলে এসব নোট সরবরাহ করা হতো।
র্যাব জানায়, এসব জাল নোটের এক লাখ টাকার একটি বান্ডেল তৈরিতে চক্রটির খরচ পড়তো মাত্র দুই হাজার টাকা। আর প্রতি লাখের জাল নোট বিক্রি করা হতো ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়।
দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসা এ চক্রের মূলহোতা মো. শাহজাদা আলম (৩৩) ও তার অন্যতম সহযোগী মো. মাহেদী হাসান (১৯) এবং আবু হুরায়রা ওরফে তুষারকে (২২) আটকের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র্যাব-৩।
সোমবার (১৯ জুন) রাতে রাজধানীর উত্তরখান থানাধীন মাস্টারপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ৯০০টি ২০০ টাকার জাল নোট ও ২০০টি ১০০ টাকার জালনোট মিলিয়ে সর্বমোট দুই লাখ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়।
এছাড়া জাল নোট তৈরিতে একটি ল্যাপটপ, একটি ল্যাপটপ ব্যাগ, একটি কি-বোর্ড, দুটি মাউস, দুটি ল্যাপটপ চার্জার, একটি পেনড্রাইভ, ১০টি বিশেষ মার্কার পেন ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
মঙ্গলবার (২০ জুন) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলি র্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, শাহজাদা, মাহেদী ও তুষার মিলে গত ছয় মাস ধরে জাল টাকার কারবার শুরু করে। মাহেদী আগে থেকেই ফটোশপ ও গ্রাফিক্সের কাজ জানত। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইউটিউব থেকে জাল টাকা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া দুই বন্ধু শাহজাদা ও তুষারের সহযোগিতায় জাল টাকা তৈরির কাজ শুরু করে।
শাহজাদা ও তুষার দীর্ঘদিন ধরেই জাল টাকা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। একপর্যায়ে মাহেদীকে সঙ্গে নিয়ে তারা নিজেরাই জাল টাকা বানানোর কাজ শুরু করে।
জাল টাকা বানানোর প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, তারা প্রথমত অনলাইন থেকে বাংলাদেশি বিভিন্ন নোটের ছবি ডাউনলোড করে তাদের ল্যাপটপে সংরক্ষণ করে। পরে ছবিগুলো এ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটর ব্যবহার করে এপিঠ-ওপিঠ সমন্বয় করে প্রিন্ট করা হতো। মোটা ও পিচ্ছিল অফসেট কাগজের ওপর এক পাতায় চারটি নোট প্রিন্ট করা হতো। এরপর সেই নোটগুলোতে তারা গোল্ডেন কালার মার্কার দিয়ে নিরাপত্তা সুতার আদলে মার্কিং করে। সবশেষে স্টিলের স্কেল এবং কাটার দিয়ে জাল নোটগুলো কেটে বান্ডেল করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হতো।
এভাবে ৫০টি নোটের একটি বান্ডেল তৈরিতে তাদের আনুমানিক ২০০ টাকা খরচ হতো। অর্থাৎ এক লাখ টাকা তৈরিতে তাদের আনুমানিক খরচ হয় দুই হাজার টাকা।
তিনি বলেন, তৈরি জাল নোটগুলো বিক্রির জন্য শাহজাদা ও তুষার ফেসবুকে জাল টাকা ক্রয়-বিক্রির বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপে পোস্ট দিতেন। জাল টাকা ক্রয়ে আগ্রহী কমেন্টকারীদের সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করতেন। পরে তারা ফোন কলে ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জাল টাকা ডেলিভারি করতেন।
চক্রটি এ পর্যন্ত জাল টাকার বড় চারটি ডেলিভারি দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, গত ১৫ জুন তারা ‘এ গ্রেড’ জাল নোট গ্রুপের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকার ৫০০, ২০০ ও ১০০ টাকার জাল নোটের একটি ডেলিভারি দেয়। যার বিনিময় মূল্য হিসেবে ৯০ হাজার টাকা নেয়। ১৯ জুন দুই লাখ টাকার জাল নোট ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতিকালে টাকা ও সরঞ্জামাদিসহ তাদের আটক করা হয়।
আটক শাহজাদা চক্রের মূলহোতা। তিনি ২০০৮ সালে বিজিবিতে যোগদান করেন এবং ২০২০ সালে নৈতিক স্খলন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত হন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
২০২২ সাল থেকে শাহজাদা জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্রের সঙ্গে কাজ করে আসছে। ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে ফেসবুকে জাল টাকা বিক্রির পেজ থেকে পরিচিত হয়ে মাহেদী এবং তুষারকে নিয়ে তিনি নিজেই জাল টাকা প্রস্তুতের চক্রটি গড়ে তোলেন।
তখন থেকে মাহেদী ও তুষারকে শাহজাদা তার উত্তরখানের ভাড়া বাসায় নিয়ে আসেন। এখান থেকেই তারা তাদের পরবর্তী কার্যক্রম চালাতে থাকে। গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা বাসা ছেড়ে গাজীপুরে আরেকটি ভাড়া বাসায় চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
র্যাব-৩ অধিনায়ক আরও বলেন, তুষার আগে গাজীপুর কাশিমপুরে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। বর্তমানে চাকরি ছেড়ে পুরোদমে জাল টাকার ডেলিভারির কাজ করতেন। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুরে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন গিয়ে জাল টাকা বিক্রির জন্য ক্রেতাও ঠিক করতেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২৩
পিএম/আরআইএস